এক নজরে টাঙ্গাইল জেলা

ছবি: মেট্টো টিভি

ছবি: মেট্টো টিভি

প্রকাশিত

টাঙ্গাইলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইতিহাসের দৃষ্টিপথে পিছনে তাকালে দেখা যায়, বঙ্গীয় বদ্বীপে কবে মানব বসতি শুরু হয়েছে, তার সঠিক যুক্তিনির্ভর তথ্য এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে গবেষকদের মতে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিকাংশ এলাকা সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। শুধু মধুপুর-ভাওয়াল বনাঞ্চল উঁচু ভূমি হিসেবে ছিল। ধারণা করা হয়, সোমেশ্বরী নদীর পাড়ের গারো পাহাড় থেকে ভাওয়াল গড় পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়মালাই বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন স্থলভাগ, যার বড় অংশই টাঙ্গাইলের অন্তর্গত।

<div class="paragraphs"><p>পাখির চোখে টাঙ্গাইল জেলা; ছবি: মেট্টো টিভি</p></div>

পাখির চোখে টাঙ্গাইল জেলা; ছবি: মেট্টো টিভি

টাঙ্গাইলের নামকরণ ও প্রশাসনিক ইতিহাস

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গাইল এক সময় কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্রে টাঙ্গাইলকে আটিয়া অঞ্চল হিসেবে দেখানো হয়েছে। ১৮৭০ সালের ১৫ নভেম্বর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইল মহকুমা সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হলে টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে। ১৮৭২ সালে টাঙ্গাইল মহকুমার আয়তন ছিল ১০৪১ বর্গমাইল। এর অধীনে ছিল টাঙ্গাইল, কালিহাতী ও গোপালপুর থানা এবং নাগরপুর, মির্জাপুর, ঘাটাইল ও জগন্নাথগঞ্জ ফাঁড়ি থানা। পরবর্তীতে জগন্নাথগঞ্জকে পাবনা ও মধুপুরকে টাঙ্গাইলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

<div class="paragraphs"><p>টাঙ্গাইলের প্রাচীন স্থাপনা; ছবি: মেট্টো টিভি</p></div>

টাঙ্গাইলের প্রাচীন স্থাপনা; ছবি: মেট্টো টিভি

১৯৫০ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ-এর উদ্যোগে "টাঙ্গাইল জেলা চাই" আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার টাঙ্গাইলকে জেলা করার কার্যক্রম হাতে নেয়। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল পূর্ব পাকিস্তানের ১৯তম জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে এটি ১২টি উপজেলা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে টাঙ্গাইলের আয়তন ৩৪১৪.৩৫ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ।

টাঙ্গাইলের অর্থনীতি ও কৃষি

টাঙ্গাইল কৃষিনির্ভর জেলা। এখানে প্রচুর পরিমাণে পাট, ধান, আনারস, কলা, কাঠাল ও শাকসবজি উৎপাদিত হয়। গোপালপুরের পাট, মধুপুর ও সখিপুরের আনারস, মির্জাপুর ও ঘাটাইলের কাঠাল বিখ্যাত। ২০২২ সালের কৃষি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, টাঙ্গাইল কলা ও আনারস উৎপাদনে দেশের শীর্ষ জেলার তালিকায় রয়েছে।

<div class="paragraphs"><p>টাঙ্গাইলের কৃষি জমি; ছবি: মেট্টো টিভি</p></div>

টাঙ্গাইলের কৃষি জমি; ছবি: মেট্টো টিভি

ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও তাঁত

টাঙ্গাইলের সবচেয়ে গর্বের বিষয় হলো টাঙ্গাইল শাড়ি। স্থানীয় তাঁতিদের হাতে তৈরি এই শাড়ি দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় প্রায় ৭৬ হাজার তাঁতি এই শিল্পের সাথে যুক্ত। তবে ৭ হাজার তাঁত ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, যা শিল্পটিকে হুমকির মুখে ফেলছে। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের উচিত এই শিল্পকে রক্ষা করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

<div class="paragraphs"><p>ঐতিহাসিক তাঁত শিল্প; ছবি: মেট্টো টিভি</p></div>

ঐতিহাসিক তাঁত শিল্প; ছবি: মেট্টো টিভি

বিখ্যাত মিষ্টান্ন ও খাবার

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম মিষ্টি প্রায় দুই শতাব্দী ধরে স্বনামধন্য। ব্রিটিশ আমল থেকে এই মিষ্টির খ্যাতি ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া দানাদার, রসগোল্লা, আমৃত্তি, জিলাপি, সন্দেশ, দই, রসমালাই, কালোজাম ইত্যাদি এখানকার জনপ্রিয় মিষ্টান্ন।

<div class="paragraphs"><p>টাঙ্গাইলের চমচম; ছবি: মেট্টো টিভি</p></div>

টাঙ্গাইলের চমচম; ছবি: মেট্টো টিভি

লোকঐতিহ্য ও সংস্কৃতি

টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলেছে প্রচলিত প্রবাদ— “চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি”। একসময় টমটম গাড়ি এখানকার প্রধান বাহন ছিল, যা কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়েছে।

এ জেলার লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল মৃৎশিল্প ও নকশী কাঁথা। বর্তমানে বাণিজ্যিকরণের কারণে নকশী কাঁথার প্রভাব কিছুটা কমেছে এবং মৃৎশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। এছাড়া কাঁসা-পিতল, বাঁশ-বেতের সামগ্রী ও ঐতিহ্যবাহী লৌকিক খেলাধুলাও টাঙ্গাইলের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ।

<div class="paragraphs"><p>গুচ্ছ গ্রাম, টাঙ্গাইল; ছবি: মেট্টো টিভি</p></div>

গুচ্ছ গ্রাম, টাঙ্গাইল; ছবি: মেট্টো টিভি

দর্শনীয় স্থান ও স্থাপত্য

টাঙ্গাইলে রয়েছে বহু ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মুসলিম ঐতিহ্যের মধ্যে আটিয়া মসজিদ, ধনবাড়ি মসজিদ ও মাজার, কদিম হামজানি মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হিন্দু ঐতিহ্যের মধ্যে গুপ্ত বৃন্দাবন, পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রম, বারো তীর্থ, আনন্দ মঠ উল্লেখযোগ্য। জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে মহেরা, হেমনগর, করটিয়া, দেলদুয়ার ও পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি অন্যতম।

নতুন প্রজন্মের কাছে টাঙ্গাইলের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে ২০১ গম্বুজ মসজিদ। এছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাল-সেন আমলের সভ্যতার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে।

<div class="paragraphs"><p>২০১ গম্বুজ মসজিদ, টাঙ্গাইল; ছবি: মেট্টো টিভি</p></div>

২০১ গম্বুজ মসজিদ, টাঙ্গাইল; ছবি: মেট্টো টিভি

যোগাযোগ ব্যবস্থা

টাঙ্গাইলের যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের অন্যতম উন্নত সড়ক ও রেলপথ দ্বারা সমৃদ্ধ। ঢাকা-বগুড়া চার লেনের মহাসড়ক এ জেলার ওপর দিয়ে গিয়েছে। উত্তরের সাথে দক্ষিণবঙ্গের একমাত্র রেল সংযোগও টাঙ্গাইলের ওপর দিয়ে চলে। বঙ্গবন্ধু সেতু দেশের অন্যতম প্রধান যোগাযোগ স্থাপনা হিসেবে টাঙ্গাইলের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত।

<div class="paragraphs"><p>সড়ক ব্যবস্থা, টাঙ্গাইল; ছবি: মেট্টো টিভি</p></div>

সড়ক ব্যবস্থা, টাঙ্গাইল; ছবি: মেট্টো টিভি

পর্যটন ও রাবার শিল্প

টাঙ্গাইলের মধুপুরের রাবার বাগান দেশের অন্যতম বৃহৎ রাবার উৎপাদন কেন্দ্র। প্রায় ৩০০০ একর এলাকা জুড়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার রাবার গাছ রয়েছে, যা পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ।

ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে টাঙ্গাইল ঢাকা বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এখানকার তাঁত, চমচম, কৃষি ও লোকসংস্কৃতি টাঙ্গাইলকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যথাযথ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে টাঙ্গাইল তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com