
দেয়ালে টানানো ছবিটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মেয়েটি। মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে বলে, ‘আম্মু’। কিন্তু ছবির তো জবাব নেই। মেয়েটি বোঝে না, তার মা এখন চার দেয়ালে বন্দি—লাল দালানের ভেতরে।
ঠাকুরগাঁও শহরের পূর্ব হাজিপাড়ার এই শিশুটি বাকপ্রতিবন্ধী। বয়স ১৭-১৮বছর। আগে ছিল চঞ্চল, প্রাণবন্ত। এখন সে মনমরা। কোনো কথাই বলে না, খাবার মুখে তুলতে চায় না। আচমকা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ঘরের এক কোণ থেকে আরেক কোণে যায়, খুঁজে ফেরে মাকে। আত্মীয়দের দেখলেই একটাই প্রশ্ন—‘আম্মু কোথায়?’
মেয়েটির মা আঞ্জুমান আরা বেগম বন্যা গত ৯ মাস ধরে কারাবন্দি। একটি মামলায় জামিন পেলেও পরপর একাধিক মামলা দিয়ে তাঁর মুক্তির পথ আটকে দেওয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এটি প্রতিহিংসামূলক আচরণ।
বন্যার স্বামী এক সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে পড়েছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলেন বন্যা। মেয়েটিও ছোটবেলায় অপহরণের শিকার হওয়ার পর থেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। মা-ই ছিল তার পৃথিবী।
সুইড বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক স্বপ্না রানী বলেন, ‘এই শিশুটির সবকিছুই ছিল তার মা। এখন সে পুরোপুরি অসহায়।’
ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এমএস কবির জুয়েল বলেন, ‘এ ধরনের শিশুরা যখন নির্ভরতার জায়গা হারায়, তখন তারা আরও বেশি মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়।’
ঠাকুরগাঁও জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুর রহিম বলেন, ‘আঞ্জুমান আরা বেগম একটি মামলায় জামিন পাওয়ার পরও তাঁকে হয়রানি করে নতুন মামলা দেওয়া হয়েছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঠাকুরগাঁও জেলা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বলেন, ‘এটি শুধু অমানবিকই নয়, একটি শিশুর ভবিষ্যৎ ধ্বংসের শামিল। সরকারের উচিত দ্রুত এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা এবং মানবিক দিক বিবেচনায় তাঁর মুক্তি নিশ্চিত করা।’
নির্বাক শিশুটির কান্নায় যেন গোটা সমাজের দায় উঠে আসে—একজন মায়ের মুক্তির অপেক্ষায় সে আজও তাকিয়ে আছে ছবির দিকে।