মিছিলের সামনে নিহত অটোচালক সুজনের স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান। 

 
দেশ

দরিদ্র অটোচালক সুজন হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবীতে উত্তাল বাউফলের প্রত্যন্ত জনপদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দরিদ্র অটোচালক সুজন হত্যার প্রতিবাদ ও আসামীদের গ্রেফতারের দাবীতে উত্তাল হয়ে উঠেছে বাউফলের প্রত্যন্ত জনপদ কনকদিয়া ইউনিয়নের নারায়নপাশা, আমিরাবাদ ও আশেপাশের এলাকা। গত ২৭ জানুয়ারী সংঘটিত ওই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আয়োজিত একাধিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে দলমত নির্বিশেষে সকল স্তরের নারী-পুরুষ।  

প্রতিবাদকারীদের একটাই দাবী সুজন হত্যায় যারা সশরীরে অংশ নিয়েছে এবং তাদের নির্দেশদাতাদের সকলকেই গ্রেফতার করতে হবে। জনতার দাবীর মুখে পুলিশও তৎপর হয়ে একাধিক আসামীকে গ্রেফতার করেছে। তবে, ভয়ংকর হিংস্র প্রকৃতির মূনঈমুল ইসলাম মিরাজ (২৮)-কে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

বুধবার পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার আনোয়ার জাহিদ দি মেট্রো টিভি কে জানান, ‘পুলিশ মিরাজসহ অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতারে সকল সম্ভাব্য উপায় কাজে লাগাচ্ছে। এর আগে প্রধান আসামীসহ আরও ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’    

এদিকে, বাউফলের অধিবাসী ও জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় নেতা ড. মু. শফিকুল ইসলাম মাসুদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সুজনের হত্যাকারীদের অন্যতম মিরাজকে নিয়ে এক পোস্ট দিয়েছেন। তিনি পোস্টে বলেন, ‘বাউফলে মিরাজ নামের এই ছেলেটির বিরুদ্ধে আগেও আমরা সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির অভিযোগ পেয়েছি। আমরা বারংবার প্রশাসনকে আহবান জানিয়েছি বাউফলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। যদি আইন শৃঙ্খলার ব্যাপারে সরকার ও পুলিশ প্রশাসন আরো আন্তরিক হতো তাহলে এই মর্মান্তিক ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো না।’

ড. মাসুদ বলেন, ‘উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক মূনঈমুল ইসলাম মিরাজ (২৮) ও তার অনুসারীদের দ্বারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অবিলম্বে প্রশাসনের প্রতি সন্ত্রাসী মিরাজ তার অনুসারীদের বিচারের আওতায় আনার আহবান করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘একই সাথে আমাদের বন্ধুপ্রতিম সংগঠন বিএনপি নেতাদের প্রতি অনুরোধ করবো আপনারা সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেবেন না। আপনাদের দলীয় সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আওয়ামী লীগের পরিণতি বরণ করতে হবে।’

এছাড়া, দরিদ্র অটোচালক সুজন হত্যার প্রতিবাদে বাউফলে ও ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল এবং মানববন্ধন কর্মসুচি পালিত হয়েছে। ওই দুটি কর্মসুচিতেই অংশগ্রহনকারীরা সুজন হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে জাহাঙ্গীর হাওলাদার ও তার ভাই মনজুর সরোয়ারকে দায়ী করে তাদেরকে গ্রেফতারে জোর দাবী জানান।

সুজন হত্যায় নেতৃত্ব দেয়া কে এই মিরাজ?

এলাকার বখাটে হিসেবে পরিচিত মূনঈমুল ইসলাম মিরাজ নারায়নপাশা গ্রামের মনজুর সরোয়ারের বড় ছেলে। গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীর হাওলাদার মিরাজের বড় চাচা। মিরাজের কনিষ্ঠ সহোদর ভাই মোরসালিন সকল প্রকার অপরাধমূলক কর্মকান্ডে তার অন্যতম সহযোগী। গত ৫ আগস্টের পর জাহাঙ্গীর হাওলাদার ও তার ভাই মনজুর সরোয়ার এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে কাজে লাগায় তাদের পরিবারের উত্তরসূরী মিরাজ, তার অনূজ মোরসালিন ও তাদের সহযোগী আরও ২০-২৫ জনকে। গড়ে তোলে এক শক্তিশালী বাহিনী। তারা দিনরাত ওই এলাকা দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। মাসিক ৫ হাজার টাকা চাঁদা চেয়ে না পেয়ে সুজনকে হত্যার আগে বেশ কয়েকবার তার সারাদিনের আয় মিরাজের লোকজন ছিনিয়ে নিয়ে যায় বলেও পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।   

স্থানীয় সুত্রগুলো জানায়, উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক পরিচয়ে মিরাজ তার বাপ-চাচার ইচ্ছে পূরণে ম্যান্ডেট নিয়ে মাঠে নামে। একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকান্ড ও চাঁদাবাজিতে বেপরোয়া হয়ে উঠে মিরাজ গং। তাদের চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়ের ভাগ পাবার শর্তে তাদের পিছনে এক মহীরুহের মতো কোর্ট-কাচারি ও আইনী ঝামেলা থেকে আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করেন এক আইনজীবি। ওই আইনজীবিকে তারা চাচা বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এসব কারণে বাউফলের প্রত্যন্ত ওই এলাকার সাধারন শান্তিপ্রিয় মানুষ মিরাজ ও তার পরিবারের সকলকে ভয়ে সমীহ করে চলে। এতোদিন ছোটখাটো অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলেও সুজন হত্যার পর সাধারন মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তুলেছে।  

এলাকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুরুব্বিরা মিরাজ গংয়ের প্রধান বাধা

নারায়নপাশা ও তার আশেপাশের গ্রামে মিরাজ গংয়ের বেপরোয়া কর্মকান্ড সামলাতে তার বাপ-চাচাকে দুই-একবার পরামর্শ দিয়েছিলেন ওই এলাকার খানকায়ে কাদেরিয়া দরবার শরীফের মুতাওয়াল্লি পীরজাদা মশিউর রহমান। কিন্ত সেজন্য মিরাজ স্থানীয় বাজারে বসে তার ছোট ভাই মোরসালিনকে দিয়ে খানকায়ে শরীফ থেকে পীরজাদা মশিউর রহমানকে ডেকে পাঠায়। এ সময় পীরজাদা মশিউর নামাজরত অবস্থায় থাকার নিরবতায় চিৎকার চেচামেচি করে মোরসালিন। ওই ঘটনায় অবাক হয়েছেন এলাকাটির মুরুব্বিরা। পীরজাদা মশিউর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ‍যুক্ত। কিন্ত তার পিতা খানকায়ে কাদেরিয়া দরবার শরীফের প্রাক্তন মুতওয়াল্লি পীরজাদা হাবিবুর রহমানের মৃত্যু হলে পরিবারের সম্মতিতে তিনি দরবার শরীফের দায়িত্ব নেন। সেই হিসেবে তাকে এলাকার লোকজন সমীহের চোখেই দেখে থাকেন। কিন্ত মিরাজ ও তার সহযোগীদের দিয়ে তার বাপ-চাচারা পীরজাদা মশিউর রহমানকেও অসম্মান করতে ছাড় দেয় নি। স্থানীয় লোকজনের দাবী, এসব কারণে এলাকার মানুষ সুজন হত্যাকান্ডের পর মিরাজ ও তার বাপ-চাচাদের বিরুদ্ধে এক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে চলেছে।