কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় লবণ চাষিদের মাঝে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। মাঠ পর্যায়ে লবণ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম কমে যাচ্ছে, যা চাষিদের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৌসুমের শুরুতে প্রতি মণ লবণ ২৮০ থেকে ২৬০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে দাম নেমে এসেছে ২০০ টাকায়। এতে প্রতি মণ লবণ বিক্রিতে চাষিদের ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের ঘোনারপাড়া এলাকার লবণ চাষি জকির মিয়া এবার ১০ কানি জমিতে লবণ চাষ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তার উৎপাদন ভালো হয়েছে। গত আড়াই মাসে তিনি এক হাজার মণ লবণ উৎপাদন করেছেন। তবে লবণের দাম কমে যাওয়ায় তিনি হতাশ। তিনি বলেন, "জানুয়ারি মাসে লবণ বিক্রি হয়েছিল ২৪০ টাকায়, কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে দাম কমে ২০০ টাকায় নেমে এসেছে। এতে প্রতি মণ লবণে আমার ১৭০ টাকা লোকসান হচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমরা পথে বসব।"
জকির মিয়ার মতে, লবণের দাম কমে যাওয়ার পেছনে দালাল ও সিন্ডিকেটের ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, "এখানে সবকিছুই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। জমি, ত্রিপল, পানি কিংবা লবণ বিক্রি—সবকিছুই তারা নিয়ন্ত্রণ করে। এই সিন্ডিকেট লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে।"
চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের হায়দারপাড়ার লবণ চাষি নুরুল আজিম ও মোহাম্মদ জসিমও একই সমস্যার মুখোমুখি। তারা দুভাই ৪ কানি জমিতে লবণ চাষ করেছেন এবং গত দুই মাসে ১৭০ মণ লবণ উৎপাদন করেছেন। তাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট ইচ্ছাকৃতভাবে লবণের দাম কমিয়ে দিচ্ছে, যাতে চাষিরা লবণ উৎপাদন বন্ধ করে দেন। নুরুল আজিম বলেন, "সিন্ডিকেট চায় চাষিরা লবণ উৎপাদন বন্ধ করে দিক। এতে দেশে লবণের সংকট তৈরি হলে তারা বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে পারবে।"
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় লবণ চাষ হচ্ছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন লাখ ৩৮ হাজার ১২৪ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। এবার লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন, যা দেশের বার্ষিক চাহিদার সমান।
বিসিক কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, সরকার লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে নিবিড়ভাবে মনিটরিং করছে। তিনি বলেন, "মিলারদের উৎসাহিত করা হচ্ছে যাতে তারা মাঠ পর্যায়ের চাষিদের কাছ থেকে লবণ কিনে নেয়। এখন লবণ আমদানির সুযোগ নেই।"
তবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, "মার্চ-এপ্রিল লবণ উৎপাদনের পিক সিজন। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে, তাহলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমরা আশাবাদী।"
এদিকে, লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় অনেক চাষি উৎপাদিত লবণ মাঠে গর্ত খুঁড়ে সংরক্ষণ করছেন। বিসিক ও চাষিদের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই লাখ ৯৯ হাজার ২৯৫ মেট্রিক টন লবণ গর্তে মজুত করা হয়েছে। বিসিকের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, "গুদামে লবণ মজুত করলে তা শুকিয়ে যায়, কিন্তু গর্তে রাখলে লবণ নিরাপদে থাকে।"
কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। বর্তমানে ৪৪ হাজার চাষি এই খাতে জড়িত রয়েছেন। গত মৌসুমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ৯ উপজেলায় ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল, যা বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
চাষিদের দাবি, লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা না হলে আগামীতে লবণ উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন তারা। এ অবস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপ ও সিন্ডিকেটের কবল থেকে মুক্তির দাবি জানাচ্ছেন লবণ চাষিরা।