ভাগ্য বিড়ম্বিত এক যুবকের নাম জাফর সরদার। ভাগ্য বদলাতে চাকরি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সাইপ্রাস। যেখানে যাওয়া তো দুরে থাক তিনি এখন রয়েছেন রনাঙ্গনে। প্রতিদিন মৃত্যুর আশংকায় তার দিন কাটছে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। দেশের ফেরার আশায় ক্ষুদে বার্তায় নিজের অবস্থান জানিয়ে সরকারের কাছে সহযোগিতা কামনা করছেন প্রতিমূহুর্তে।
এদিকে সুস্থভাবে দেশে ফিরে আসার জন্য মসজিদে মসজিদে মিলাদ দিচ্ছেন বাবা। স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে প্রায় বাকরুদ্ধ তার স্ত্রী।
যশোরের যুবক জাফর সরদারের এই করুণ কাহিনী জানা গেলো তার পরিবারের মুখে।মাসহ জাফরের পরিবারের সব সদস্যের দাবি, সরকার যেকোনো উপায়ে তাদের ছেলেকে মুক্ত করে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিক।
জানা গেছে, স্বপ্নের চাকরি নিয়ে সাইপ্রাসে যাওয়ার জন্য দালালের খপ্পরে পড়ে নানা দেশ ঘুরে বর্তমানে জাফরের ঠাঁই হয়েছে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে রাশিয়ান সৈন্যদের রান্নাবান্নার কাজ করানোর কথা বলে ব্যারাকে নেওয়া হলেও পুরোদস্তুর সামরিক কায়দায় সাজানো হয়েছে তাকে। দেওয়া হচ্ছে সামরিক প্রশিক্ষণও।
তবে আশার খবর, জাফর সরদার সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাত আড়াইটার দিকে স্ত্রীর মোবাইলফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছেন যে, তাকে তখনো যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হয়নি। তবে তিনি সৈনিকদের সঙ্গেই আছেন। এতদিন তিনি যে ক্যাম্পে ছিলেন সেটা থেকে অন্য একটা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। বর্তমানে ঠিকমতো খেতে দেওয়া হচ্ছে। বাকিটা ‘আল্লাহর হাত’ বলে ক্ষুদেবার্তা শেষ করেন জাফর।
জাফর সরদারের বাড়ি যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের বড় মেঘলা গ্রামে। গ্রামটি যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের গালফ ফিলিং স্টেশনের পেছনে। মহাসড়ক থেকে তাদের বাড়িও দেখা যায়। এই ফিলিং স্টেশনের পশ্চিম পাশে একটি চায়ের দোকান পরিচালনা করেন জাফরের বাবা খায়রুল হোসেন সরদার।
খায়রুল হোসেন সরদার, জাফরের মা হাসিনা বেগম এবং চাচাতো বোন রেক্সোনা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। পাশেই ছিল জাফরের ৭ বছরের ছেলে।
খায়রুল হোসেন বলেন, ‘আজও ছেলের ফিরে আসার আশায় আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে জিলাপি কিনে দুটো মসজিদে মিলাদ দিয়ে এলাম। এভাবে প্রতি শুক্রবার মসজিদে মসজিদে মিলাদ দিচ্ছি। আল্লাহ যদি ডাক শোনেন। আর তো কোনো উপায় দেখতিছি না। কেউ কোনো আশার বাণী শুনাতি পারতিছে না। ’
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেরে সাইপ্রাস নিয়ে যাওয়ার কথা কয়ে দালাল রাশিয়ায় ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে। সেখানে তারে দিয়ে যুদ্ধ করানো হচ্ছে। এটা কোনো বাপ-মা মেনে নিতে পারে না। ছেলে আমার এখন বাঁচার আকুতি জানায়ে বারবার মেসেজ দিচ্ছে। নেটেও (ফেসবুক) নিজির অবস্থা তুলে ধরে দেশে ফিরে আসার জন্য কান্নাকাটি করেছে। আমি চাকরি-বাকরি বুঝিনে, শুধু একটাই প্রত্যাশা সরকার আমার ছেলেরে দেশে ফিরায়ে আইনে দিক’।
খায়রুল সরদারের দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলেও দালালের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়ায় যেয়ে আটক হয়েছেন। তিনি প্রায় দেড় মাস সেখানে জেলখানায় আছেন।
এসব কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না জানিয়ে খায়রুল সরদার বলেন, ‘একদিকি দুই ছেলের চিন্তা, আর একদিকি এতগুলো মানুষির সংসার চালানোর চিন্তা-আমার আর কিছুই ভালো লাগে না। তার ওপর কেউ কোনো আশাও দিতি পারতেছে না। এখন কী করবো, কোথায় যাব, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। খালি এ মসজিদ ও মসজিদি মিলাদ দিচ্ছি, আল্লাহ যদি আমার ছেলেডারে যুদ্ধের মাঠ থেকে বাড়িতে ফিরায়ে দেয় সেই আশায়’। জাফরের স্ত্রী খাদিজা আক্তার (২৮) শিশু কন্যাকে কোলে দাঁড়িয়েছিলেন। কথা হয় তার সঙ্গে।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে দূরে সরে যাচ্ছিলেন খাদিজা, আর বলছিলেন তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না। শুধু বলছিলেন, ‘আমি খুব অসুস্থ, আমি কোনো কথা বলবো না। অনেক সাংবাদিক সব তথ্য নিয়ে গেছে। কোনো লাভ হয়নি। ’
সর্বশেষ তিনি বলেন, ‘তাকে (স্বামী জাফর) বিক্রি করা হয়েছে ২০ লাখ টাকায়। সরকারের কাছে আমার আবেদন যেকোনো মূল্যে তাকে ফিরে পেতে চাই’।
জাফরের মা হাসিনা বেগম জানান, দালাল তাকে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে যুদ্ধের কারণে নিরাপত্তার শঙ্কা থাকায় তারা ছেলেকে পাঠাতে চাননি। তখন দালাল, দালালের মামাতো ভাই ও ভাবি তাদেরকে বোঝান, কোনো সমস্যা হবে না। জাফরকে সেখানে ক্লিনারের চাকরি দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘দালাল কাজ দেওয়ার কথা বলে আমার ছেলেরে নিয়ে গেছে। তারে কাজ না দিয়ে কেনো যুদ্ধে লাগালো। আমার ছেলেরে আমার কাছে ফিরায়ে দিক। ’
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার ‘ড্রিম হোম ট্রাভেলস’ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে গত বছরের ১৭ আগস্ট সাইপ্রাসের উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন জাফর সরদার। এজন্য তারা একটি এনজিওর কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা ঋণ করেন। জাফরের মা ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করেন এবং মানুষের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করেন। এভাবে মোট আট লাখ টাকা তারা দিয়েছেন ড্রিম হোম ট্রাভেলসকে।
এই রিক্রুটিং এজেন্সি জাফরকে সাইপ্রাস নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ভিসার জন্য সে দেশের দূতাবাসে কাগজপত্র জমা দিয়েছিল। কিন্তু, দুই বছরেও কোনো ভিসা না পেয়ে তাকে রাশিয়ায় নেওয়ার কথা বলে নিয়ে যায় সৌদি আরবে। সেখান থেকে দুমাস পর দুবাই, লিবিয়া বা তুরস্ক হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাশিয়ায়। জাফরের সঙ্গে দালাল আরও নয়জন বাংলাদেশি মোট দশজনকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসেন আকরাম নামে নরসিংদীর এক যুবক। নয়জনকে জোর করে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য পাঠানো হয় ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে তাদের মধ্যে একজন নিহত এবং একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
এদিকে, দালালের খপ্পরে পড়ে রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো বাংলাদেশি নয়টি পরিবারের সদস্যরা সন্তানদের মুক্তির দাবিতে কয়েক দফা ঢাকায় মানববন্ধন করেছেন। তারা একাধিকবার গেছেন রাশিয়ান দূতাবাস এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
সবাই শুধু আশ্বাস দিয়েছেন জানিয়ে জাফর সরদারের চাচাতো কোন রেক্সোনা বলেছেন, তিনি ৯ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে সেখান থেকে জানানো হয় যেহেতু তারা বৈধভাবে যায়নি, সেহেতু একটু সময় লাগবে।