ছবি : সংগৃহীত

রংপুর জেলা

দেশের বাইরেও পরিচিতি পাচ্ছে শহীদ আবু সাঈদের গ্রাম বাবনপুর

নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বাবনপুর গ্রাম। সন্ধ্যা নামার পরপরই যেন রাত নেমে আসে এই জনপদে। দেশের হাজারো গ্রামের মতোই শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতি। বিশেষ পরিচিতি পাওয়ার মতো কোনো বিশেষত্বও ছিল না এতকাল। কিন্তু রংপুর থেকে বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে বাবনপুর এখন পরিচিতি পেয়েছে বিশ্বে। গ্রামটি এখন দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশও। গুগলে খুঁজলেই পাওয়া যাচ্ছে এই গ্রামের নাম। যার কারণে প্রত্যন্ত এ জনপথ ঠাঁই পেল বিশ্ব দুয়ারে, তিনি শহীদ আবু সাঈদ। তার ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাবনপুরে পা রেখেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ দেশের বরেণ্য রাজনীতিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, প্রখ্যাত আলেম সমাজসহ সাধারণ মানুষ।

সরেজমিন দেখা যায়, ঘটনার পরিক্রমায় বদলে গেছে বাবনপুরের দৃশ্যপটও। গ্রামীণ মেঠো পথে বসানো হয়েছে ইট। আবু সাঈদের বাড়ি এবং কবরকে চিনতে নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ সাইনবোর্ড ও চিহ্নও।

বদলেছে আরও অনেক কিছুই। পীরগঞ্জ-খালাশপীর সড়ক থেকে জাফরপাড়া স্কুল সংলগ্ন আবু সাঈদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তার নামকরণ হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ আবু সাঈদ সড়ক নামে। জাফরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শহীদ আবু সাঈদ কর্নার এবং শহীদ আবু সাঈদ সংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের উদ্যোগে নির্মাণ হচ্ছে ওয়াশ ব্লক।

স্থানীয়রা জানান, আবু সাঈদের কবর ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই অর্ধশতাধিক মানুষ আসছেন বাবনপুরে।

কবর জিয়ারত করছেন। স্থানীয় বাজারটিও এখন তার নামে চিনছে মানুষ। রাতারাতি বিখ্যাত বনে যাওয়া গ্রামটিকে চিনতে আর কষ্ট হচ্ছে না দূরের কারও। বাবনপুরকে নিয়ে গর্ব করেন গ্রামবাসীও। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মক্তব, মন্দির, হাট-বাজার, দোকান-খামার, গল্পখানায় একটাই নাম—আবু সাঈদ।

বাবনপুর শহীদ আবু সাঈদ যুবসংঘের সাধারণ সম্পাদক মিলন মিয়া বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পরই আমাদের গ্রাম পরিচিতি পেয়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। সরকারপ্রধানসহ অনেকেই এসেছেন। তার নামে ফাউন্ডেশন গঠন, মেডিকেল কলেজ স্থাপন, রাস্তা প্রশস্তকরণ, মসজিদ স্থাপনসহ নানামুখী উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে।

আবু সাঈদের স্বপ্নের বৈষম্যহীন দেশ নির্মাণে সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গ্রামের আজিজার রহমান।

আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেন বলেন, ভাইয়ের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পূর্ণতা পেয়েছিল। তার কারণেই এ গ্রাম আজ আলোকিত। সবাই আজ তার জন্য এ গ্রামকে চেনেন-জানেন।

জাফরপাড়া স্কুলের সহকারী শিক্ষক বকুল মিয়া জানান, আমাদের জাফরপাড়া বাবনপুর আজ একনামে সবার কাছে পরিচিত। আর সেটা আবু সাঈদের নাম।

রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক মাজেদুল ইসলাম বলেন, ড. জোহার কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে চিনেছিল বিশ্ববাসী। আর আবু সাঈদের কারণে চিনেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও বাবনপুর গ্রামকে।

বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. আবু সালেহ মো. ওয়াদুদুর রহমান তুহিন বলেন, আবু সাঈদ আমাদের গর্ব। সে আমাদের আনেক কিছুই শিখিয়ে গেছে। তার ঋণ শোধ হওয়ার নয়।

গত ১০ আগস্ট আবু সাঈদের কবরে শ্রদ্ধা জানান ড. ইউনূস। সঙ্গে ছিলেন দুই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। সেদিন দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার পায় এই সফর। রংপুরের সঙ্গে পীরগঞ্জ, সেসঙ্গে বাবনপুর গ্রাম জড়িয়ে সংবাদ প্রচারিত হয় দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেল এবং অনলাইন মিডিয়ায়ও। বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় উঠে আসে বাবনপুরের নাম। সেদিন ড. ইউনূস বলেছিলেন, রংপুর হবে ১ নম্বর। তারও আগে, সেখানে যান জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জোনায়েদ সাকীসহ বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, ছাত্র ও সামাজিক সংগঠন।

গত ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটে সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান বাবনপুরের এই বীর। খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে ঘটনাটি প্রকাশ পেলে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। এর প্রতিবাদে মৃত্যুকে তাচ্ছিল্য করে আন্দোলনে অংশ নেন লাখো ছাত্র-জনতা। জোরেশোরে দাবি তোলেন, সরকার পতনের একদফার। শেষ পর্যন্ত গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন বাংলাদেশে স্বৈরাচার মুক্তির ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠেন আবু সাঈদ আর তার জন্মস্থান বাবনপুর গ্রাম।