দেশের প্রধান অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোতে কয়েক মাস ধরেই বিক্রি কমার প্রবণতা স্পষ্ট। আগে যেখানে মাস শেষে সেলারদের ‘হাই সেল’ উদযাপন ছিল নিয়মিত, এখন সেখানে উদ্বেগ—“ক্রেতা আসছে না, অর্ডার কমে গেছে।”
ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে-প্রথম আঘাত এখানেই-
দেশে সামগ্রিক ভোক্তা ব্যয় কমে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় অনলাইনে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার প্রবণতা আগের মতো নেই।
অনলাইনে কেনার প্রধান গ্রাহক–যুবসমাজ–সেখানেও বাজেট কমিয়ে দিয়েছে।
একজন সেলার বললেন, “আগে দিনে ৫০টা অর্ডার আসত, এখন ১২–১৫ টা আসে। মানুষের হাতে অতিরিক্ত টাকা নেই।”
ডেলিভারি চার্জ বাড়ায় ‘এনগেজড ইউজার’ কমে গেছে-
কুরিয়ার কোম্পানিগুলোর খরচ বাড়ায় ডেলিভারি চার্জ বেড়েছে।
পূর্বে 60–70 টাকার মধ্যে ঢাকার ডেলিভারি পাওয়া গেলেও এখন অনেক জায়গায় 120–150 টাকা পর্যন্ত লেগে যায়।
ফলে কম দামের পণ্যে ক্রেতারা আগ্রহ হারাচ্ছে—কারণ পণ্যদামের সমান ডেলিভারি চার্জ দিতে অনেকেই রাজি নয়।
ফেক সেলার বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতার আস্থা কমেছে-
অনলাইন কেনাকাটায় আস্থা আগের মতো নেই।
ডুপ্লিকেট পণ্য, ভুল সাইজ, ভেজাল কসমেটিক এবং রিটার্ন না নেওয়ার অভিযোগ বেড়ে গেছে।
মার্কেটপ্লেসগুলো কোটি টাকা মুনাফা করলেও অভিযোগ ব্যবস্থাপনায় ‘টাইমলি অ্যাকশন’ না থাকায় নিয়মিত ক্রেতারা আশাহত।
ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের খরচ বেড়েছে—ছোট সেলারদের পৌঁছানো কমে গেছে-
ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে অ্যাড খরচ ৩০%–৬০% পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
ছোট ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন দিতে না পারায় তাদের পেজ আর মার্কেটপ্লেস শপে ট্রাফিক কমে গেছে।
যারা আগে দিনে ১,০০০ টাকায় প্রচারণা চালাতে পারত, এখন সেই একই ফল পেতে লাগে ২,৫০০–৩,০০০ টাকা।
‘ইমপালস বাইং’ কমে গেছে-
যে গ্রাহকরা আগে রাত ২টার সময় হঠাৎ মোবাইল কভার বা ড্রেস অর্ডার করতেন—এখন তারা দাম তুলনা করে, পরে ভাবেন, বা একদম কিনেন না।
সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপ মানুষের ‘হঠাৎ কেনা’ মনস্তত্ত্বকে দমন করেছে।
লজিস্টিক ধীর—ডেলিভারি টাইম বেশি-
আগে যেখানে ২৪ ঘণ্টায় ডেলিভারি পাওয়া যেত, এখন অনেক মার্কেটপ্লেসে ৩–৫ দিন লাগছে।
ডেলিভারি দেরি হলে ক্রেতারা দ্বিতীয়বার অর্ডার করতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোর ভেতরকার সমস্যাও বড় কারণ-
অ্যালগরিদমে রিচ কমে যাওয়া
সেলার কমিশন বাড়ানো
মান নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা
ক্যাম্পেইন কমে যাওয়া (বিশেষত মাঝারি সেলারদের জন্য)
ফলে আগে যারা মার্কেটপ্লেসকে প্রধান বিক্রির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখতেন, এখন তারা বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের করণীয়: সংকটময় সময়ের টিকে থাকার স্ট্র্যাটেজি-
নিজস্ব ওয়েবসাইট/অ্যাপ রাখা-মার্কেটপ্লেসের উপর পুরোপুরি নির্ভর না থাকা
প্রি-অর্ডার ভিত্তিক বিক্রি-স্টক ঝুঁকি কমানো
টিকটক-লাইভ কমার্স বাড়ানো-দ্রুত গ্রাহক পাওয়ার সেরা মাধ্যম
গ্রাহক আস্থায় জোর দেওয়া-রিটার্ন/রিফান্ড দ্রুত করা
কম দামের, হালকা পণ্য বাড়ানো-ডেলিভারি খরচ সামঞ্জস্য করতে
রেগুলার কন্টেন্ট মার্কেটিং-অতিরিক্ত পেইড অ্যাড ছাড়াই পৌঁছানো বাড়াতে
লজিস্টিক কোম্পানি পরিবর্তন করে সস্তা বিকল্প খোঁজা
শেষকথা-
অনলাইন মার্কেটপ্লেসে মন্দা সাময়িক হলেও, ক্রেতার ‘ট্রাস্ট’ ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মার্কেটপ্লেস যদি কমিশন, অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং ডেলিভারি ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন না আনে—তাহলে ২০২৫ সাল ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের বছর হয়ে উঠবে।