কৃষক ঘামে ভিজে উৎপাদন করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য বাজারে পৌঁছাচ্ছে না। এই ন্যায্যমূল্যহীনতার পেছনে কাজ করছে মধ্যস্বত্বভোগীর জটিল চক্র, যারা কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে অতিরিক্ত সুবিধা নিচ্ছেন। চক্রটি কেবল কৃষকের আয়ের ক্ষতি করছে না, বরং বাজারের স্থিতিশীলতা ও ভোক্তার স্বস্তিকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
মধ্যস্বত্বভোগী চক্র কেমন কাজ করে?
বাংলাদেশের কৃষিপণ্য সরবরাহ চেইন প্রথাগতভাবে অনেক ধাপে বিভক্ত। উদাহরণস্বরূপ, হালকা সবজি বা ডাল খাত:
কৃষক: ফসল উৎপাদন করে, কিন্তু সংরক্ষণ বা সরাসরি বাজারে বিক্রির সুযোগ নেই।
আড়তদার/মধ্যস্বত্বভোগী: কৃষকের কাছ থেকে কম দামে কিনে পাইকার বা হোলসেল মার্কেটে বিক্রি করে, মাঝখানে প্রায় ২০–৩০% লাভ নিশ্চিত করে।
পাইকার/ডিস্ট্রিবিউটার: হোলসেল মার্কেট থেকে দোকানে বা বড় শহরের বাজারে পৌঁছে দেয়।
বিক্রেতা: ভোক্তার কাছে বিক্রি করে চূড়ান্ত দাম স্থির করে।
প্রতিটি ধাপে দাম বাড়লেও কৃষকের হাতে নগদ আসে মূল উৎপাদন খরচের তুলনায় সীমিত। একে বলা যায়, “লাভের বড় অংশ মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে চলে যাচ্ছে”।
কৃষকের ক্ষতি এবং বাজারের প্রভাব
কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেলে উৎপাদনে উৎসাহ হারান। ফলস্বরূপ:
ফসলের ঘাটতি বা অতিরিক্ত সরবরাহের সমস্যা তৈরি হয়।
বাজারে দামের ওঠানামা বেড়ে যায়।
ভোক্তা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হয়।
একই সাথে, এসএমই খাতেও প্রভাব পড়ছে, কারণ খাদ্য ও কাঁচামালের দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ঘাটতি
বাংলাদেশে ফসল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অবকাঠামো সীমিত। হিমায়িত সিলো, শুকনো স্টোরেজ বা প্রক্রিয়াজাতকরণের সুবিধা না থাকায় মৌসুমি ফসল বাজারে একসাথে ঢুকে দাম কমে যায়। আবার অফ-সিজনে সেই পণ্য পাওয়া গেলে দাম আবার বেড়ে যায়, কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে দামের ফাঁক আরও বড় হয়।
পরিসংখ্যানের আড়াল
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, ধান ও আলুর বাজার চেইনের ৩০–৩৫% মূল্য মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে যায়।
একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরাসরি কৃষক-বাজার সংযোগ থাকলে ন্যায্যমূল্য কমপক্ষে ১৫–২০% বেশি কৃষকের হাতে পৌঁছানো সম্ভব।
নীতিগত সমাধান
বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগীর চক্র ভাঙতে হলে:
সরাসরি কৃষক–বাজার সংযোগ: ডিজিটাল কৃষক বাজার, হোলসেল প্ল্যাটফর্ম।
সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি: হিমাগার, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে বিনিয়োগ।
মূল্য তদারকি ও স্বচ্ছতা: বাজারে দর ও লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
ঋণ ও আর্থিক সহায়তা: কৃষক যাতে আগে থেকে বিনিয়োগ ও সঞ্চয় করতে পারেন।
প্রশিক্ষণ ও তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত: কৃষক যাতে বাজার চাহিদা অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করতে পারেন।
মাঠ পর্যায়ের উদাহরণ
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষক শেখ কামালের উদাহরণ চোখে পড়ার মতো। গত মৌসুমে তিনি ৫ বিঘা ধান উৎপাদন করেছিলেন, কিন্তু আড়তদার থেকে পাইকার পর্যন্ত চেইন খরচের কারণে তার আয়ের ২৫% কমে যায়। একই সময়ে স্থানীয় বাজারে ধান বিক্রি দামের ৩০% বেশি ছিল। তিনি বলেন, “আমরা ঘামে ভিজে উৎপাদন করি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুবিধা অন্যের পকেটে যায়”।
শেষ কথা
মধ্যস্বত্বভোগীর চক্র কেবল কৃষকের ক্ষতি করছে না, এটি পুরো বাজার চেইন ও অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ওপরও চাপ সৃষ্টি করছে। কৃষক বাঁচলে বাজার বাঁচে, বাজার স্থিতিশীল থাকলে অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। তাই ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে চক্রটি ভাঙা এখন আর বিকল্প নয়, এটি দেশের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য।