অর্থনীতি

ডিজিটাল মুদ্রা ও ক্যাশলেস সমাজ: সুবিধা, ঝুঁকি ও বদলে যাওয়া অর্থনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

একসময় মানিব্যাগে নগদ টাকা না থাকলে অস্বস্তি হতো। আজ উল্টো চিত্র- মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট আর একটি ডিজিটাল ওয়ালেট থাকলেই অনেকের কাছে মানিব্যাগ অপ্রয়োজনীয়। কিউআর কোড স্ক্যান করে চা কেনা থেকে শুরু করে বড় অঙ্কের লেনদেন, সবই এখন ডিজিটাল। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ক্যাশলেস সমাজের ধারণা এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা।

প্রশ্ন হলো, এই রূপান্তর কি কেবল সুবিধার গল্প, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে নতুন ধরনের ঝুঁকি ও বৈষম্য?

ক্যাশলেস সমাজ কীভাবে বাস্তব হয়ে উঠছে

ক্যাশলেস সমাজ বলতে এমন একটি ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়, যেখানে দৈনন্দিন লেনদেনের বড় অংশ নগদ অর্থ ছাড়া ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, অনলাইন ব্যাংকিং এবং কিউআরভিত্তিক পেমেন্ট, সব মিলিয়ে অর্থনীতির একটি বড় অংশ ধীরে ধীরে কাগুজে টাকার বাইরে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই পরিবর্তন আরও দ্রুত হয়েছে কোভিড-পরবর্তী সময়ে। স্বাস্থ্যঝুঁকি, সময় সাশ্রয় ও সহজ লেনদেন, এই তিন কারণে ডিজিটাল পেমেন্ট জনপ্রিয়তা পায়। দোকানদার থেকে শুরু করে রিকশাচালক পর্যন্ত এখন ডিজিটাল লেনদেনের সঙ্গে পরিচিত।

ডিজিটাল মুদ্রা: নতুন অর্থনীতির ভাষা

ডিজিটাল মুদ্রা বলতে শুধু ক্রিপ্টোকারেন্সি নয়, বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক-নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC) থেকেও শুরু করে বিভিন্ন ই-মানি ব্যবস্থাকে বোঝায়। অনেক দেশ এখন নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা চালুর পথে এগোচ্ছে, যাতে লেনদেন সহজ হয়, খরচ কমে এবং অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও কার্যকর হয়।

এই ব্যবস্থায় টাকা আর কেবল নোট বা কয়েন নয়, এটি হয়ে উঠছে ডেটা। কোথায় খরচ হলো, কতক্ষণে লেনদেন সম্পন্ন হলো, সবকিছুই তাৎক্ষণিকভাবে ট্র্যাক করা সম্ভব হচ্ছে।

সুবিধার দিক: গতি, স্বচ্ছতা ও অন্তর্ভুক্তি

ডিজিটাল মুদ্রা ও ক্যাশলেস ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো গতি। লেনদেন দ্রুত হয়, সময় ও শ্রম বাঁচে। ব্যবসায়ীরা হিসাব রাখতে পারেন সহজে, সরকার কর আদায়ে পায় স্বচ্ছতা।

একই সঙ্গে এটি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুযোগ তৈরি করে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলেও মোবাইল ওয়ালেটের মাধ্যমে অনেক মানুষ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষও ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার আওতায় আসছে।

ঝুঁকির জায়গা: নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ

তবে সুবিধার পাশাপাশি ঝুঁকিও কম নয়। সাইবার অপরাধ, হ্যাকিং, প্রতারণা,ডিজিটাল অর্থনীতির অন্ধকার দিক। একটি ভুল ক্লিক বা ফাঁদে পড়া লিংক মুহূর্তেই খালি করে দিতে পারে একটি অ্যাকাউন্ট।

আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো নিয়ন্ত্রণ। যখন সব লেনদেন ডিজিটাল হয়, তখন ব্যক্তির আর্থিক গোপনীয়তা কতটা সুরক্ষিত থাকে? কে দেখছে, কে বিশ্লেষণ করছে, আর সেই তথ্য কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর এখনো পুরোপুরি নেই।

ডিজিটাল বৈষম্যের আশঙ্কা

ক্যাশলেস সমাজ সবার জন্য সমান নয়। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সংযোগ বা ডিজিটাল দক্ষতা, এই তিনটি না থাকলে মানুষ সহজেই পিছিয়ে পড়ে। প্রবীণ জনগোষ্ঠী, দরিদ্র মানুষ বা প্রান্তিক অঞ্চলের বাসিন্দারা এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

ফলে একটি নতুন ধরনের বৈষম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, যেখানে নগদ অর্থে অভ্যস্ত মানুষ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।

রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা

ডিজিটাল মুদ্রা ও ক্যাশলেস সমাজ টেকসই করতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী নীতিমালা। সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা, ব্যবহারকারীর ডেটা সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল শিক্ষায় বিনিয়োগ, এই তিনটি বিষয় এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

একই সঙ্গে নগদ ও ডিজিটাল- এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য রাখা জরুরি, যাতে কেউ হঠাৎ করে বাদ পড়ে না যায়।

উপসংহার

ডিজিটাল মুদ্রা ও ক্যাশলেস সমাজ ভবিষ্যতের একটি অবধারিত বাস্তবতা। এটি অর্থনীতিকে দ্রুত, স্বচ্ছ ও আধুনিক করছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে এই রূপান্তর যদি মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, তাহলে সুবিধার চেয়ে সমস্যাই বেশি তৈরি করবে।

প্রশ্ন তাই প্রযুক্তিকে গ্রহণ করব কি না, তা নয়। প্রশ্ন হলো, কীভাবে গ্রহণ করব। ডিজিটাল মুদ্রা মানুষের জীবন সহজ করবে, নাকি মানুষকে আরও নিয়ন্ত্রিত করবে, এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে আজকের নীতিনির্ধারণ ও সচেতন ব্যবহারের ওপর।