অর্থনীতি

বিদেশি বিনিয়োগ কমছে: বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে কোন বার্তা দিচ্ছে এই প্রবণতা?

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশি বিনিয়োগ বা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (FDI) দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক ধরনের আস্থার সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। নতুন কারখানা, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি হস্তান্তর- সবকিছুর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এই বিনিয়োগ।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই চিত্র বদলাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগের গতি মন্থর, কোথাও কোথাও স্পষ্ট পতনের ইঙ্গিতও মিলছে। প্রশ্ন উঠছে, এই কমে যাওয়ার অর্থ কী? এবং এর প্রভাব কতটা গভীরে গিয়ে পড়তে পারে?

সংখ্যার বাইরের বাস্তবতা

পরিসংখ্যান যতটা না ভয় দেখায়, মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা তার চেয়েও বেশি স্পষ্ট। নতুন করে বড় বিদেশি প্রকল্প ঘোষণার সংখ্যা কমছে। আগের বিনিয়োগকারীদের অনেকেই নতুন সম্প্রসারণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কেউ কেউ ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ অবস্থানে চলে গেছেন।

এক অর্থনীতিবিদের ভাষায়,

“FDI হঠাৎ চলে যায় না, কিন্তু আসা থেমে গেলে সেটা ভবিষ্যৎ সংকেত দেয়।”

ডলার সংকট ও মুনাফা দেশে নেওয়ার জটিলতা

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রধান উদ্বেগ এখন ডলার।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা একটি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা ডলারে দেশে নিতে সময় লাগছে, প্রক্রিয়া জটিল হচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে অনিশ্চয়তা থাকলে বিদেশি কোম্পানি নতুন বিনিয়োগে স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে পড়ে।

FDI আসার আগে বিনিয়োগকারীরা তিনটি বিষয় দেখে-

লাভ, নিরাপত্তা ও টাকা ফেরত নেওয়ার নিশ্চয়তা।

ডলার সংকট এই তিনটির মধ্যে অন্তত দুইটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

নীতি ও সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ শুধু কর ছাড় বা জমি দিলেই হয় না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, নীতির ধারাবাহিকতা।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে:

  • কর নীতিতে ঘন ঘন পরিবর্তন

  • হঠাৎ আমদানি নিষেধাজ্ঞা

  • রেগুলেটরি সিদ্ধান্তে পূর্বাভাসের অভাব

ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

জ্বালানি ও অবকাঠামো: পুরোনো সমস্যা, নতুন চাপ

বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট নতুন কিছু নয়, কিন্তু এর তীব্রতা এখন ব্যবসাবান্ধব নয়।

কারখানা চালু রাখার জন্য নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি প্রয়োজন, এটা বিনিয়োগের মৌলিক শর্ত।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকেই বলছেন,

“কারখানা স্থাপন করা যায়, কিন্তু উৎপাদন পরিকল্পনা করা যায় না।”

এই অনিশ্চয়তা নতুন বিনিয়োগের বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে কি?

বাংলাদেশ একা বিনিয়োগ আকর্ষণের লড়াইয়ে নেই। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, এমনকি শ্রীলঙ্কাও একই বিনিয়োগকারীদের লক্ষ্য করছে।

এই দেশগুলো যেখানে—

  • দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়

  • ওয়ান-স্টপ সার্ভিস কার্যকর

  • আইনি জটিলতা কম

সেখানে বাংলাদেশে এখনো কাগজপত্র, অনুমোদন আর দপ্তরের ঘোরাঘুরি বড় বাস্তবতা।

রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নেয়, কিন্তু অস্থিরতা পছন্দ করে না।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, নীতিগত দ্বিধা, শ্রম পরিস্থিতি—সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ধীর গতিতে।

FDI কমলে ক্ষতি কোথায় গিয়ে লাগে

বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেলে এর প্রভাব শুধু বড় কোম্পানিতে পড়ে না।

এর প্রভাব পড়ে—

  • নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে

  • প্রযুক্তি ও দক্ষতা হস্তান্তরে

  • রপ্তানি সক্ষমতায়

  • দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধিতে

সবচেয়ে বড় কথা, অর্থনীতিতে আস্থার জায়গাটাই দুর্বল হয়ে পড়ে।

তবে কি সব শেষ? নাকি এখনো সুযোগ আছে

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ এখনো সম্ভাবনার দেশ।

বড় বাজার, তরুণ জনসংখ্যা, ভৌগোলিক সুবিধা—এসব একদিনে হারিয়ে যায় না।

কিন্তু বিনিয়োগ ফেরাতে হলে দরকার-

  • ডলার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা

  • নীতিগত স্থিতিশীলতা

  • বাস্তব ওয়ান-স্টপ সার্ভিস

  • জ্বালানি নিরাপত্তা

  • সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতি

শেষ কথা
বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া কোনো একক ঘটনার ফল নয়—এটি অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থার প্রতিফলন।

এখনো সময় আছে সংকেতগুলো বোঝার, ভুলগুলো সংশোধনের। না হলে FDI কমার এই ধারা ভবিষ্যতে আরও গভীর অর্থনৈতিক চাপে রূপ নিতে পারে।

বাংলাদেশের সামনে প্রশ্ন একটাই-

আমরা কি বিনিয়োগকারীদের শুধু আমন্ত্রণ জানাব, নাকি সত্যিই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারব?