বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে আটকে আছে। একদিকে আমরা “সৃজনশীল শিক্ষা”, “চিন্তাশীল নাগরিক” আর “চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি”র কথা বলি; অন্যদিকে বাস্তব শ্রেণিকক্ষে আজও মুখস্থই সাফল্যের প্রধান শর্ত। পাঠ্যসূচি বদলেছে, পরীক্ষার নাম বদলেছে, প্রশ্নপত্রের কাঠামো বদলেছে, কিন্তু শিক্ষার আত্মা কি আদৌ বদলেছে?
এই প্রশ্নটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সৃজনশীলতার নামে নতুন মুখস্থ:
একসময় পরীক্ষায় সরাসরি প্রশ্ন-উত্তর মুখস্থ করলেই ভালো ফল করা যেত। সেই জায়গা থেকে বের হতে চালু হলো ‘সৃজনশীল প্রশ্ন’। উদ্দেশ্য ছিল, শিক্ষার্থীরা যেন ভাবতে শেখে, বিশ্লেষণ করতে শেখে, বাস্তবের সঙ্গে জ্ঞানকে যুক্ত করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কী হলো?
সৃজনশীল প্রশ্নও এখন মুখস্থের নতুন সংস্করণ। কোচিং সেন্টারগুলো তৈরি করল “কমন সৃজনশীল প্রশ্ন”, গাইড বইয়ে ছাপা হলো নির্দিষ্ট কাঠামোর উত্তর। শিক্ষার্থীরা শিখল- কীভাবে নির্দিষ্ট শব্দ ব্যবহার করলে পূর্ণ নম্বর পাওয়া যায়। ভাবনার জায়গায় জায়গা নিল ফর্মুলা। ফলে প্রশ্নের নাম বদলালেও শিক্ষা রয়ে গেল আগের জায়গাতেই।
পরীক্ষাকেন্দ্রিক ব্যবস্থার অদৃশ্য শৃঙ্খল:
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো- সবকিছু পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সাজানো। শিক্ষক পড়ান পরীক্ষার জন্য, শিক্ষার্থী পড়ে পরীক্ষার জন্য, অভিভাবক সন্তুষ্ট হন ফলাফলের মাধ্যমে। এই কাঠামোয় সৃজনশীলতা বরাবরই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’।
কারণ সৃজনশীল চিন্তা সময় চায়, ভুল করার সুযোগ চায়, প্রশ্ন করার স্বাধীনতা চায়। কিন্তু পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষায় ভুল মানেই ব্যর্থতা। প্রশ্ন মানেই সময় নষ্ট। ফলে শিক্ষার্থীরা শেখে- চুপ করে শুনতে, মুখস্থ করতে এবং পরীক্ষার খাতায় তা উগরে দিতে।
শিক্ষক কি প্রস্তুত?:
সৃজনশীল শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রথম শর্ত হলো প্রস্তুত শিক্ষক। কিন্তু আমাদের শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এখনো মূলত সিলেবাস শেষ করা আর পরীক্ষার প্রস্তুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেক শিক্ষক নিজেই এমন শিক্ষাব্যবস্থায় বড় হয়েছেন, যেখানে মুখস্থই ছিল একমাত্র পথ।
ফলে শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করলে অনেক সময় শিক্ষার্থী নিরুৎসাহিত হয়। নতুনভাবে ভাবতে চাইলে সেটাকে ‘সিলেবাসের বাইরে’ বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
এই বাস্তবতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কও হয়ে ওঠে একমুখী- শিক্ষক বলবেন, শিক্ষার্থী শুনবে।
কোচিং সংস্কৃতি: সৃজনশীলতার সবচেয়ে বড় শত্রু:
সৃজনশীলতা যেখানে ব্যক্তিগত চিন্তা ও অনুসন্ধানের বিষয়, সেখানে কোচিং সংস্কৃতি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কোচিং সেন্টার শিক্ষাকে পরিণত করেছে একটি প্যাকেজে- নির্দিষ্ট প্রশ্ন, নির্দিষ্ট উত্তর, নির্দিষ্ট সাফল্যের নিশ্চয়তা।
এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী আর শেখে না কেন পড়ছে; শেখে কীভাবে পরীক্ষায় ভালো করবে। ফলে বই পড়ার আগ্রহ কমে, নিজে ভাবার অভ্যাস হারিয়ে যায়। শিক্ষা হয়ে ওঠে কেবল একটি প্রতিযোগিতা, জ্ঞান নয়।
পাঠ্যবইয়ের সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতার দূরত্ব:
অনেক পাঠ্যবই এখনো বাস্তব জীবনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার সংযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ। বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয় তথ্যের স্তূপ হিসেবে, চিন্তার প্রক্রিয়া হিসেবে নয়। ফলে শিক্ষার্থীরা তথ্য মনে রাখে, কিন্তু সেই তথ্যের প্রয়োগ শেখে না।
বিশেষ করে সামাজিক বিজ্ঞান ও সাহিত্য শিক্ষায় এই সংকট আরও স্পষ্ট। এখানে আলোচনা, বিশ্লেষণ ও ভিন্নমত তৈরির সুযোগ থাকলেও শ্রেণিকক্ষে তা খুব কমই চর্চা হয়।
মুক্তির পথ কোথায়?
মুখস্থ থেকে মুক্তি মানে কেবল পরীক্ষার ধরন বদলানো নয়; পুরো শিক্ষাদর্শ বদলানো। শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করাকে উৎসাহিত করতে হবে, ভুলকে শেখার অংশ হিসেবে দেখতে হবে। শিক্ষককে হতে হবে গাইড, বক্তা নয়।
একই সঙ্গে মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন দরকার। শুধু লিখিত পরীক্ষার ওপর নির্ভর না করে প্রেজেন্টেশন, প্রকল্প, দলগত কাজের মতো পদ্ধতি চালু করতে হবে।
শিক্ষার্থী কী জানে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ- সে কীভাবে ভাবে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের শিক্ষায় সৃজনশীলতা বন্দী, কারণ আমরা এখনো ফলাফলকে শিক্ষার সমার্থক মনে করি। যতদিন শিক্ষা মানে কেবল জিপিএ, ততদিন মুখস্থই থাকবে রাজা। কিন্তু যদি আমরা সত্যিই চিন্তাশীল, মানবিক ও দায়িত্ববান নাগরিক গড়তে চাই, তাহলে শিক্ষাকে পরীক্ষার খাঁচা থেকে মুক্ত করতেই হবে।
মুখস্থ দিয়ে হয়তো পরীক্ষায় পাস করা যায়, কিন্তু জীবন বোঝা যায় না। আর শিক্ষার মূল লক্ষ্য যদি জীবন বোঝানো হয়, তবে সৃজনশীলতার মুক্তিই হোক আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরবর্তী অধ্যায়।