শিক্ষা

স্কুল-কলেজে বিতর্ক ও সাহিত্যচর্চা: নেতৃত্ব তৈরির অদৃশ্য কারখানা

নিজস্ব প্রতিবেদক

একটি সমাজের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কেবল পাঠ্যবই, পরীক্ষা বা সনদ দিয়ে তৈরি হয় না। নেতৃত্ব গড়ে ওঠে চিন্তার চর্চায়, মত প্রকাশের সাহসে এবং ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করার ক্ষমতায়। বাংলাদেশে এই নেতৃত্ব তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলিত ক্ষেত্র হলো স্কুল–কলেজের বিতর্ক ও সাহিত্যচর্চা। ক্লাসরুমের বাইরের এই কার্যক্রমগুলো নীরবে তৈরি করে আত্মবিশ্বাসী, যুক্তিবাদী ও দায়িত্বশীল নাগরিক, যাদের প্রয়োজন একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সবচেয়ে বেশি।

পাঠ্যসূচির বাইরে যে শিক্ষা সবচেয়ে গভীর

ডিবেট ক্লাব, সাহিত্যসভা, দেয়াল পত্রিকা, স্কুল ম্যাগাজিন, আবৃত্তি বা নাট্যচর্চা, এসব কার্যক্রম কোনো পরীক্ষার নম্বর দেয় না। কিন্তু এগুলোই শিক্ষার্থীদের শেখায় কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে শুনতে হয়, কীভাবে যুক্তি দাঁড় করাতে হয় এবং কীভাবে ভিন্নমতের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হয়।

একজন শিক্ষার্থী যখন বিতর্কে অংশ নেয়, সে কেবল বক্তব্য দেয় না; সে শিখে প্রমাণ খুঁজতে, তথ্য যাচাই করতে এবং আবেগ নয়, যুক্তির ওপর দাঁড়াতে। এই অভ্যাসই ভবিষ্যতে তাকে একজন সচেতন নাগরিক বা নেতৃত্বের উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।

সাহিত্যচর্চা ও মানবিক নেতৃত্ব

সাহিত্যচর্চা নেতৃত্বের একটি ভিন্ন কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক তৈরি করে, মানবিকতা। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা নাটকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অন্য মানুষের জীবন, বেদনা ও সংগ্রামকে অনুভব করতে শেখে। এই অনুভব ছাড়া নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতা হয়ে ওঠে, দায়িত্ব নয়।

একজন নেতা যদি সাহিত্য না পড়ে, মানুষের মনস্তত্ত্ব না বোঝে, তবে তার সিদ্ধান্ত যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। সাহিত্য শিক্ষার্থীদের শেখায় সহমর্মিতা, নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং আত্মসমালোচনার ক্ষমতা, যা একজন প্রকৃত নেতার অপরিহার্য গুণ।

অতীত ঐতিহ্য, বর্তমান সংকট

একসময় বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে বিতর্ক ও সাহিত্যচর্চা ছিল নিয়মিত ও সম্মানজনক কার্যক্রম। বহু জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী তাদের নেতৃত্বের হাতেখড়ি পেয়েছেন স্কুলের ডিবেট ক্লাব বা কলেজ ম্যাগাজিন থেকে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা, কোচিং নির্ভরতা এবং ‘ফলাফলই সব’ মানসিকতায় সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোকে অনেক সময় বিলাসিতা হিসেবে দেখা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে এসব ক্লাব কেবল নামেই আছে; কার্যক্রম নেই, পৃষ্ঠপোষকতা নেই।

ডিজিটাল যুগে বিতর্কের সংকুচিত চর্চা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের সুযোগ বাড়িয়েছে, কিন্তু গভীর বিতর্কের চর্চা কমিয়েছে। দ্রুত মন্তব্য, আবেগী প্রতিক্রিয়া এবং বিভাজনমূলক ভাষা যুক্তিবাদী আলোচনা প্রতিস্থাপন করছে। এর বিপরীতে স্কুল-কলেজের নিয়ন্ত্রিত বিতর্কচর্চা শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারত শালীনতা, তথ্যভিত্তিক কথা বলা এবং মতভেদের মধ্যেও সম্মান বজায় রাখা।

এই জায়গাটিই এখন সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত।

নেতৃত্ব তৈরির ‘অদৃশ্য কারখানা’ কেন?

কারণ বিতর্ক ও সাহিত্যচর্চা কোনো সনদ দেয় না, কোনো তাৎক্ষণিক ফলাফল দেখায় না। এর ফল পাওয়া যায় সময়ের সঙ্গে, যখন একজন শিক্ষার্থী সমাজে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্তিবোধ দেখায়, কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করে।

এই কারণেই এটি অদৃশ্য। কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে এটি শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশগুলোর একটি।

করণীয় কী?

স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বিতর্ক ও সাহিত্যচর্চাকে ঐচ্ছিক নয়, বরং শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখতে হবে। নিয়মিত আন্তঃপ্রতিষ্ঠান বিতর্ক, সাহিত্য কর্মশালা, পাঠচক্র ও প্রকাশনা কার্যক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা জরুরি।

শিক্ষকদেরও কেবল পাঠদানকারী নয়, বরং মেন্টর হিসেবে ভূমিকা রাখতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ পরিবেশে মত প্রকাশ করতে পারে।

উপসংহার

একটি জাতি যদি চিন্তাশীল নেতৃত্ব চায়, তবে তাকে পরীক্ষার বাইরে তাকাতে হবে। বিতর্ক ও সাহিত্যচর্চা কোনো অতিরিক্ত কার্যক্রম নয়; এটি নাগরিকত্ব শেখানোর সবচেয়ে কার্যকর পাঠশালা।

স্কুল-কলেজের এই নীরব কারখানাগুলো থেকেই তৈরি হয় ভবিষ্যতের নেতা, বুদ্ধিজীবী ও দায়িত্বশীল মানুষ।

প্রশ্ন হলো- আমরা কি এখনো সেই কারখানাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে চাই, নাকি ফলাফলের চাপে সেগুলো হারিয়ে যেতে দেব?