শিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সংকট: ডিগ্রি বাড়ছে, জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে কি?

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রতিবছরই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাড়ছে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রিধারীর সংখ্যাও। কাগজে-কলমে এই চিত্র আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এর বিপরীতে একটি মৌলিক প্রশ্ন ক্রমেই সামনে আসছে, ডিগ্রির এই বিস্তারের সঙ্গে কি জ্ঞানের বিস্তারও ঘটছে? নাকি গবেষণাহীন উচ্চশিক্ষা আমাদের একটি ফাঁপা কাঠামোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই সামনে আসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা সংকট, একটি নীরব কিন্তু গভীর সমস্যা।

গবেষণা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়: নাম আছে, ভূমিকা নেই-

বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক পরিচয় কেবল পাঠদান নয়; গবেষণার মাধ্যমেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক জ্ঞানভাণ্ডারে অবদান রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম এখনো প্রান্তিক।

অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত ডিগ্রি বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সেমিস্টার শেষ হয়, পরীক্ষা হয়, ফল প্রকাশ হয়, কিন্তু গবেষণালব্ধ নতুন জ্ঞান কোথায়? সমাজের বাস্তব সমস্যা নিয়ে গবেষণার ফল কোথায়? এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না।

শিক্ষক সংকট ও গবেষণার চাপ-

গবেষণার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি শিক্ষক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অতিরিক্ত পাঠদানের চাপে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ই পান না। বিশেষ করে নতুন ও মধ্যম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন শিক্ষককে সপ্তাহে একাধিক কোর্স পড়াতে হয়, পরীক্ষা নিতে হয়, প্রশাসনিক দায়িত্বও সামলাতে হয়।

এই পরিস্থিতিতে গবেষণা অনেক সময় হয়ে ওঠে কেবল পদোন্নতির শর্ত পূরণের একটি আনুষ্ঠানিকতা। গভীর, দীর্ঘমেয়াদি ও মৌলিক গবেষণার জায়গা সেখানে তৈরি হয় না।

অর্থায়নের অভাব ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা-

গবেষণা মানেই অর্থ, উপকরণ ও সময়ের সমন্বয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ অত্যন্ত সীমিত। আধুনিক ল্যাব, ডেটাবেইস, জার্নাল সাবস্ক্রিপশন কিংবা গবেষণা সহায়তা, সবকিছুরই ঘাটতি প্রকট।

বিশেষ করে সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক শাখায় গবেষণার অর্থায়ন প্রায় উপেক্ষিত। অথচ রাষ্ট্রীয় নীতি, সামাজিক বৈষম্য, উন্নয়ন বা মানসিক স্বাস্থ্য, এসব বিষয়ে গবেষণা ছাড়া টেকসই অগ্রগতি সম্ভব নয়।

পিএইচডি গবেষণা: মান না সংখ্যার প্রতিযোগিতা?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই গবেষণাগুলোর মান কতটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ? অনেক ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয় পুনরাবৃত্তিমূলক, পদ্ধতি দুর্বল এবং ফলাফল সীমিত পরিসরে আবদ্ধ।

পিএইচডি অনেক সময় হয়ে উঠছে চাকরি বা পদোন্নতির সিঁড়ি, জ্ঞান সৃষ্টির প্রকল্প নয়।

এই প্রবণতা গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

গবেষণা ও সমাজের বিচ্ছিন্নতা-

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা যদি সমাজের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে সংযুক্ত না হয়, তবে তা কেবল কাগজে বন্দী জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশে বহু গবেষণা থিসিস লাইব্রেরির তাকেই শেষ গন্তব্য হিসেবে বেছে নেয়।

দুর্যোগ, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, এসব বিষয়ে গবেষণা হলেও তা নীতিনির্ধারণ বা বাস্তব প্রয়োগে খুব কমই প্রতিফলিত হয়।

গবেষণা ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতা উচ্চশিক্ষার কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী না হওয়া-

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বড় অংশ গবেষণাকে সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। দ্রুত ডিগ্রি শেষ করে চাকরিতে প্রবেশই হয়ে ওঠে প্রধান লক্ষ্য। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় মেন্টরশিপ, উৎসাহ ও কাঠামোগত সহায়তার অভাবে শিক্ষার্থীরা গবেষণা থেকে দূরে সরে যায়।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ধারাবাহিকতা তৈরি হয় না।

উত্তরণের পথ কোথায়?

গবেষণা সংকট কাটাতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন নীতিগত অগ্রাধিকার। গবেষণার জন্য নির্দিষ্ট বাজেট, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও গবেষণা প্রকাশনায় উৎসাহ বাড়াতে হবে।

একই সঙ্গে গবেষণাকে পদোন্নতির আনুষ্ঠানিক শর্ত না বানিয়ে তার মান ও প্রভাবকে মূল্যায়নের আওতায় আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়–রাষ্ট্র-শিল্পখাতের সমন্বয় গবেষণাকে বাস্তবমুখী করতে পারে।

উপসংহার-

ডিগ্রি বাড়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু সেই ডিগ্রির পেছনে যদি জ্ঞান সৃষ্টির শক্ত ভিত্তি না থাকে, তবে উচ্চশিক্ষা কেবল সংখ্যার খেলায় পরিণত হবে। একটি জাতির উন্নয়ন নির্ভর করে তার গবেষণার গভীরতার ওপর, ডিগ্রির সংখ্যার ওপর নয়।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি সত্যিকার অর্থে জ্ঞানকেন্দ্র হয়ে উঠতে চায়, তবে গবেষণাকে বিলাসিতা নয়, অপরিহার্য দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে।

প্রশ্নটা এখন আর ডিগ্রি বাড়ছে কি না, প্রশ্নটা হলো, আমরা আদৌ কিছু নতুন জানতে পারছি কি না।