বিনোদন

লোকসংগীতের পুনরুজ্জীবন: শহুরে শ্রোতার কাছে গ্রামীণ সুর

নিজস্ব প্রতিবেদক

এক সময় লোকসংগীতকে মনে করা হতো গ্রামকেন্দ্রিক, সীমিত শ্রোতার শিল্পধারা। শহুরে বিনোদনের জগতে তখন আধুনিক গান, ব্যান্ড সংগীত কিংবা পাশ্চাত্য সুরের দাপট। কিন্তু সময় বদলেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ইউটিউব, লাইভ কনসার্ট ও ফিউশন ধারার হাত ধরে আজ লোকসংগীত আবারও ফিরছে, শহরের ড্রইংরুম থেকে শুরু করে কনসার্ট স্টেজ অবধি।

শেকড়ের টানে ফিরে দেখা:

লোকসংগীত কেবল গান নয়; এটি জীবনবোধ, দর্শন আর মানুষের আবেগের প্রকাশ। ভাটিয়ালি, বাউল, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি কিংবা মুর্শিদি, প্রতিটি ধারাই বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ ও আধ্যাত্মিকতার গল্প বলে। আধুনিক জীবনের যান্ত্রিকতায় ক্লান্ত শহুরে শ্রোতারা এখন খুঁজছেন এমন এক সুর, যেখানে রয়েছে মাটির গন্ধ ও আত্মিক প্রশান্তি। লোকসংগীত সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে।

ফিউশন সংগীতের হাত ধরে নতুন যাত্রা:

লোকসংগীতের পুনরুত্থানে বড় ভূমিকা রেখেছে ফিউশন ধারা। ঐতিহ্যবাহী সুরের সঙ্গে আধুনিক অ্যারেঞ্জমেন্ট, গিটার, ড্রামস কিংবা ইলেকট্রনিক বিট যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন শ্রুতিমধুর অভিজ্ঞতা। এতে একদিকে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে, অন্যদিকে মূল সুরও হারিয়ে যাচ্ছে না।

ফলে লোকসংগীত আর কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, এটি হয়ে উঠছে বর্তমান সময়েরও জনপ্রিয় ধারার অংশ।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রভাব:

ইউটিউব, স্পটিফাই, ফেসবুক ও শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্ম লোকসংগীতকে পৌঁছে দিয়েছে বৈশ্বিক শ্রোতার কাছে। আগে যেখানে একজন লোকশিল্পীর কণ্ঠ সীমাবদ্ধ ছিল নির্দিষ্ট অঞ্চল বা মেলায়, এখন সেই গান মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে। ভাইরাল হওয়া অনেক লোকগানই প্রমাণ করছে- ভাষা বা লোকাল সীমানা নয়, অনুভূতিই মূল শক্তি।

শহুরে মঞ্চে গ্রামীণ শিল্পী:

এক সময় লোকশিল্পীরা মূলত গ্রামীণ উৎসব বা পালাগানে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তারা নিয়মিত পারফর্ম করছেন শহরের বড় মঞ্চে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ও আন্তর্জাতিক উৎসবে। এতে শিল্পীদের আর্থিক নিরাপত্তা যেমন বাড়ছে, তেমনি লোকসংগীতও পাচ্ছে প্রাপ্য মর্যাদা।

ঐতিহ্য সংরক্ষণ বনাম বাণিজ্যিকীকরণ:

তবে পুনরুজ্জীবনের এই ধারার সঙ্গে একটি বিতর্কও জড়িয়ে আছে। অনেকের প্রশ্ন- ফিউশনের নামে কি লোকসংগীত তার মৌলিকতা হারাচ্ছে? বাণিজ্যিক চাহিদার চাপে কি মূল দর্শন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারসাম্যই এখানে মূল কথা। আধুনিক উপস্থাপন থাকলেও লোকসংগীতের ভাব, ভাষা ও দর্শন অক্ষুণ্ন রাখতে পারলেই এই ধারার ভবিষ্যৎ নিরাপদ।

নতুন প্রজন্মের দায় ও সম্ভাবনা:

লোকসংগীতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তরুণ প্রজন্মের ওপর। তারা যদি এই সুরকে কেবল ট্রেন্ড হিসেবে নয়, বরং ঐতিহ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তবে লোকসংগীত আরও সমৃদ্ধ হবে।

গবেষণা, আর্কাইভ তৈরি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এই ধারাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে।

উপসংহার:

লোকসংগীতের পুনরুজ্জীবন প্রমাণ করে- মানুষ যত আধুনিকই হোক, তার শেকড়ের টান কখনো মুছে যায় না। শহুরে কোলাহলের ভিড়েও গ্রামীণ সুর আজ নতুন করে জায়গা করে নিচ্ছে মানুষের মনে। এই পুনরাগমন শুধু বিনোদনের নয়, এটি সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়েরও এক শক্তিশালী ঘোষণা।