প্রবাস

দক্ষ বনাম অদক্ষ প্রবাসী: আয়, নিরাপত্তা, মর্যাদার বিস্তর ফারাক

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের প্রবাস শ্রমবাজার বহুদিন ধরেই দেশের অর্থনীতির একটি শক্ত ভিত। প্রতিবছর লাখো মানুষ কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া ও উত্তর আমেরিকায়। কিন্তু এই বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠীর ভেতরেই রয়েছে এক গভীর বিভাজন, স্কিল্ড (দক্ষ) ও আনস্কিল্ড (অদক্ষ) প্রবাসী। এই বিভাজন শুধু আয়ের পার্থক্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবনমান, কর্মনিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রশ্ন।

দক্ষতা কীভাবে ভাগ্য নির্ধারণ করে

প্রবাসে গিয়ে একজন শ্রমিক কোন কাজ করবেন, কত আয় করবেন কিংবা কতটা নিরাপদ থাকবেন, এর বড় অংশ নির্ভর করে তাঁর দক্ষতার ওপর।

দক্ষ প্রবাসীদের মধ্যে রয়েছেন প্রকৌশলী, আইটি পেশাজীবী, টেকনিশিয়ান, নার্স, কেয়ারগিভার, ওয়েল্ডার, ইলেকট্রিশিয়ান, মেশিন অপারেটর বা দক্ষ ড্রাইভাররা। অন্যদিকে আনস্কিল্ড প্রবাসীরা সাধারণত নির্মাণ শ্রমিক, ক্লিনার, হেলপার, লোডার বা সাধারণ কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।

এই দুই শ্রেণির মধ্যে আয়ের পার্থক্য অনেক ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত। যেখানে একজন দক্ষ টেকনিশিয়ান বা নার্স মাসে ভালো অঙ্কের বৈধ আয় করতে পারেন, সেখানে অদক্ষ শ্রমিকদের বড় অংশই ন্যূনতম মজুরিতে টিকে থাকার সংগ্রামে থাকেন।

আয় ছাড়াও নিরাপত্তা ও অধিকার প্রশ্নে ফারাক

শুধু বেতন নয়, দক্ষতা প্রবাসীর কর্মনিরাপত্তা ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতেও বড় ভূমিকা রাখে। দক্ষ কর্মীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে-

  • লিখিত চুক্তি

  • নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা

  • ওভারটাইম সুবিধা

  • স্বাস্থ্যবিমা ও সামাজিক সুরক্ষা

অন্যদিকে আনস্কিল্ড শ্রমিকদের বড় অংশ কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থায়। অনেক সময় চুক্তির শর্ত মানা হয় না, বেতন বকেয়া থাকে, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ মেলে না। ফলে তাদের ঝুঁকি বহুগুণ বেশি।

সামাজিক মর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের সংকট

প্রবাসে দক্ষ কর্মীরা তুলনামূলকভাবে সম্মানজনক অবস্থানে থাকেন। কর্মস্থলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ, স্থানীয় সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ এবং আত্মসম্মান বজায় রাখার ক্ষেত্রেও তারা এগিয়ে।

অন্যদিকে আনস্কিল্ড শ্রমিকদের বড় অংশ সামাজিকভাবে প্রান্তিক। ভাষাগত দুর্বলতা, অশিক্ষা ও আইনি অজ্ঞতা তাদের আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

কেন বাংলাদেশ এখনো দক্ষতায় পরিপূর্ণ নয়?

প্রশ্ন উঠছে- বাংলাদেশ কেন এখনো বড় অংশে অদক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করছে?

এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি কাঠামোগত সমস্যা:

  • পর্যাপ্ত ও মানসম্মত কারিগরি প্রশিক্ষণের অভাব

  • বিদেশি শ্রমবাজারের চাহিদা সম্পর্কে আগাম প্রস্তুতির ঘাটতি

  • দালালনির্ভর অভিবাসন ব্যবস্থা

  • ভাষা ও সফট স্কিল শেখার সুযোগের সীমাবদ্ধতা

ফলে অনেক তরুণ স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ গেলেও দক্ষতার অভাবে আটকে পড়ছেন নিম্নমানের কাজে।

দক্ষতা উন্নয়নই ভবিষ্যতের একমাত্র পথ

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবাস আয়ের টেকসই বৃদ্ধি ও শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশকে স্কিলড মাইগ্রেশনে জোর দিতে হবে।

কারিগরি শিক্ষা, ভাষা প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশন এবং দেশভিত্তিক শ্রমবাজার বিশ্লেষণ, এই চারটি জায়গায় বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি।

একজন দক্ষ প্রবাসী শুধু বেশি আয়ই করেন না, তিনি দেশের জন্য হয়ে ওঠেন দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ। অন্যদিকে অদক্ষ শ্রমিকদের ওপর নির্ভরতা অব্যাহত থাকলে রেমিট্যান্স বাড়লেও মানবিক সংকট কমবে না।

উপসংহার

প্রবাস জীবন কেবল বিদেশযাত্রা নয়, এটি প্রস্তুতির প্রতিযোগিতা। দক্ষতা যেখানে নিরাপত্তা, মর্যাদা ও স্থিতিশীলতার প্রতীক, সেখানে অদক্ষতা হয়ে উঠছে অনিশ্চয়তার নাম।

বাংলাদেশ যদি প্রবাসে সত্যিকার অর্থে লাভবান হতে চায়, তবে এখনই প্রয়োজন দক্ষ বনাম অদক্ষ বিভাজন কমিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ। কারণ প্রবাসে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে যোগ্যতা, শুধু পরিশ্রম নয়।