বাংলাদেশে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ বাহিরে কাজের সুযোগে যান। দেশজুড়ে প্রায় দুই দশক ধরে প্রবাসী কর্মীরা বাংলাদেশি পরিবারের আয়-ব্যয়ের এক বড় উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্থির ভিত্তি। কিন্তু একটাই প্রশ্ন এখন সব জায়গায় শোনা যাচ্ছে , “শুধু সংখ্যায় কর্মী পাঠিয়ে কি আরামসই রেমিট্যান্স আসবে, নাকি দক্ষ কর্মী পাঠানো জরুরি?”
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে যান, তাদের মধ্যে দক্ষতার হার বাড়েনি; বরং কিছুটা কমে গিয়েছে। যাদের দক্ষতার প্রমাণ থাকে , তারা বিদেশের উন্নত দেশগুলোর চাহিদা পূরণে যেতে পারে যেখানে অনেক বেশি বেতন, নিরাপদ কাজের পরিবেশ এবং দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ থাকে। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ কর্মী এখনো স্বল্প দক্ষ কাজে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও কিছু এশিয়ার দেশে যাওয়া বেছে নিচ্ছেন, যেখানে বেতন তুলনামূলক কম এবং কাজের অনেকটা চাপ থাকে।
আরেকটা বাস্তবতা হলো- দক্ষ কর্মীর সংখ্যাই এখন কম। গত অর্থবছরে বিদেশে যাওয়া প্রায় দশ লাখের বেশি কর্মীর মধ্যে মাত্র আঠারো শতাংশই দক্ষ হিসেবে গন্য হয়েছে, বাকিরা স্বল্প দক্ষ বা অদক্ষ হিসেবেই পাঠানো হয়েছে। পেশাদার বা উচ্চ দক্ষ জনশক্তির সংখ্যা খুবই সামান্য।
এই পরিস্থিতিটা শুধুই একটি পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ নয় এতে বড় একটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইফেক্ট তৈরি হচ্ছে। স্বল্প দক্ষ কর্মীরা সাধারণত কম বেতনে কাজ করেন এবং দেশে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সও কম থাকে। যে দেশগুলো উন্নত দক্ষ কর্মীদের চাহিদা বেশি, যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইউরোপের দেশগুলো। সেখানে পাঠানো কর্মী সংখ্যা এখনও খুব কম।
তাই বর্তমান সরকারের একটি মেজর টার্গেট হলো “দক্ষ শ্রম বাজার তৈরি করা”। এর মানে হলো, শুধু কর্মী পাঠানো নয়, কর্মীদের যোগ্যতা, ভাষা দক্ষতা এবং কারিগরি সক্ষমতা বাড়ানো, যাতে তারা উন্নত বাজারগুলোতে competitive হয়ে উঠতে পারে। এজন্য জাপান ও ইউরোপের সঙ্গে নতুন নতুন চুক্তি হচ্ছে, যাতে বিদেশে যাওয়া কর্মীরা উচ্চ বেতন, ভালো কাজের পরিবেশ এবং দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ অবস্থান পেতে পারে।
এটা সহজ হবে না। অনেক সময় আগের অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলোই দেখিয়েছে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ অনেকটা দালালি বা পরিচিতদের মাধ্যমে চলে, এবং কর্মী পাঠানো ক্ষেত্রও খুব সীমিত কিছু দেশের আশ্রয়ে থাকে। যেখানে প্রকৃতেই দক্ষতার প্রয়োজন কম, সেখানে কর্মী পাঠানো সহজ, কিন্তু আয়-ব্যয়ের সুযোগ কম।
দক্ষ শ্রম বাজারে প্রবেশ করার লক্ষ্য বাস্তবায়নে:
বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া ডিজিটাল ও স্বচ্ছ করা হচ্ছে, যাতে সময় কম লাগে এবং সব নিয়মকানুন ঠিকভাবে মানা হয়।
বিভিন্ন ভাষা (বিশেষ করে জাপানি, কোরিয়ান, ইংরেজি) এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর পরিধি বাড়ানো হচ্ছে, যাতে কর্মীরা বিদেশের উচ্চ-চাহিদাসম্পন্ন পেশায় যোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
কিছু দেশ যেমন জাপান, ইতালি বা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মৌসুমী বা দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু বা সম্প্রসারিত করা হয়েছে।
এই উদ্যোগগুলো কয়েক বছরের একটি পরিকল্পনা। তার সুফল পেতে সময় লাগবে, কিন্তু আগের “শুধু বেশি লোক পাঠানোর” ধারা থেকে বের হয়ে “দক্ষ লোক পাঠিয়ে ভালো আয় নিশ্চিত করার” লক্ষ্যটা এখন অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
সাধারণ মানুষের পর্যায়েও এটা বোঝা জরুরি যে, দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শুধু বিদেশে ভালো চাকরি পাওয়া নয়, দেশে ফিরে গিয়ে কর্মীরা আরও উন্নত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।
এটাই আজকের প্রবাসী শ্রম বাজারের প্রধান আলোচ্য বিষয়- শুধু সংখ্যা নয়, গুণে গুণে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে সক্ষম করা।
দেশে কর্মী পাঠাতে হলে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে প্রত্যেক কর্মীকে ছাড়পত্র নিতে হয়। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশে মোট কর্মী গেছেন ১১ লাখ ৯৮ হাজার ৯০০ জন। এর মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশ ছিলেন দক্ষ কর্মী। আর গত অর্থবছরে (২০২৪–২৫) গেছেন ১০ লাখ ১৫ হাজার ৩১২ জন কর্মী। এর মধ্যে দক্ষ কর্মী ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে গত অর্থবছরে পেশাদার কর্মী গেছেন মাত্র ৩ শতাংশ। দক্ষ আর আধা দক্ষ মিলে কর্মী গেছেন ৩৮ শতাংশ। বিদেশে যাওয়া বাকি ৫৯ শতাংশ কর্মী গেছেন স্বল্প দক্ষ হিসেবে