বিদেশে পা রাখার মুহূর্তে একজন প্রবাসীর সঙ্গে সবচেয়ে বড় যে সংকটটি নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায়, তা হলো ভাষা। কাজের ভিসা, থাকার অনুমতি কিংবা কর্মসংস্থানের কাগজপত্র, সব ঠিক থাকলেও ভাষা না জানার কারণে অনেক প্রবাসীর জীবন পরিণত হয় প্রতিদিনের এক নীরব সংগ্রামে। এই সংগ্রাম চোখে পড়ে না, খবরের শিরোনামও হয় না; কিন্তু এর মূল্য দিতে হয় প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে।
ভাষা: শুধু কথা নয়, টিকে থাকার হাতিয়ার
ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, প্রবাসে এটি হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার শর্ত। কর্মস্থলে নির্দেশনা বোঝা, নিরাপত্তা বিধি জানা, চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা কিংবা পুলিশের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, সবকিছুই নির্ভর করে ভাষার ওপর।
যে প্রবাসী স্থানীয় ভাষা বা অন্তত ইংরেজিতে দক্ষ নন, তিনি প্রায়ই কাজের জায়গায় পিছিয়ে পড়েন। ভুল বোঝাবুঝি থেকে তৈরি হয় ঝুঁকি, দুর্ঘটনা, এমনকি চাকরি হারানোর আশঙ্কা।
শ্রমবাজারে ভাষার প্রভাব
প্রবাসে ভাষাজ্ঞান সরাসরি প্রভাব ফেলে আয় ও পদোন্নতির ওপর। একই দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও ভাষা জানা কর্মী যেখানে সুপারভাইজার হন, সেখানে ভাষা না জানা কর্মী রয়ে যান নিম্নস্তরের কাজে। ফলে বছরের পর বছর কেটে যায়, কিন্তু আয় বাড়ে না, অবস্থার উন্নতিও হয় না।
ভাষা না জানার কারণে অনেক প্রবাসী নিজের অধিকারও আদায় করতে পারেন না। ওভারটাইমের টাকা, ছুটির সুযোগ কিংবা চুক্তির শর্ত, সবকিছুতেই তারা থাকেন অনিশ্চয়তায়।
দৈনন্দিন জীবনের নীরব কষ্ট
কর্মক্ষেত্রের বাইরেও ভাষা না জানার কষ্ট ভয়াবহ। হাসপাতালে গিয়ে নিজের অসুস্থতা বোঝাতে না পারা, ব্যাংকে গিয়ে ফর্ম পূরণে অসহায় হওয়া কিংবা সন্তানের স্কুলে শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে না পারা—এসব ছোট ছোট মুহূর্ত প্রবাসীর আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয়।
এই ভাষাগত দুর্বলতা অনেক সময় প্রবাসীদের একাকিত্ব ও মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে। তারা নিজেদের গুটিয়ে নেন, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
ভাষা জানলে বদলে যায় গল্প
অন্যদিকে, ভাষা শিখে নেওয়া প্রবাসীদের গল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্থানীয় ভাষা কিংবা ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনের পর তারা কাজের জায়গায় হয়ে ওঠেন আত্মবিশ্বাসী। সুপারভাইজারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন, নিজের অধিকার বুঝে নিতে পারেন এবং ধীরে ধীরে উন্নতির পথে এগিয়ে যান।
অনেক প্রবাসী আছেন, যারা ভাষা শেখার মাধ্যমে শুধু নিজের অবস্থান বদলাননি, বরং হয়েছেন কমিউনিটির নেতৃত্বস্থানীয় মুখ। কেউ হয়েছেন উদ্যোক্তা, কেউ আবার অনুবাদক বা প্রশিক্ষক।
সমাধান কোথায়?
ভাষা সংকট কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি একটি কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।
বিদেশ যাওয়ার আগে প্রাক-প্রবাস ভাষা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা
দূতাবাস ও কমিউনিটি সেন্টারে ফ্রি বা স্বল্পমূল্যের ভাষা কোর্স
অনলাইন ও মোবাইল অ্যাপভিত্তিক ভাষা শেখার সুযোগ
সফল প্রবাসীদের মাধ্যমে মেন্টরশিপ ও সচেতনতা ক্যাম্পেইন
এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে ভাষা আর বাধা থাকবে না, বরং হয়ে উঠবে শক্তি।
প্রমোশনাল বার্তা: ভাষা শিখুন, সম্ভাবনা খুলুন
প্রবাসে সফল হতে চাইলে ভাষা শেখার বিকল্প নেই। এটি কোনো বিলাসিতা নয়, এটি বিনিয়োগ। নিজের সময়, শ্রম আর স্বপ্নের সুরক্ষায় এই বিনিয়োগ করতেই হবে। ভাষা জানলে কাজ সহজ হয়, আয় বাড়ে, সম্মান বাড়ে, সবচেয়ে বড় কথা, জীবন হয় নিরাপদ।
শেষ কথা
ভাষা না জানার মূল্য প্রবাসীরা প্রতিদিন দিচ্ছেন, কখনো কম মজুরিতে, কখনো নীরব অপমানে, কখনো হারানো সুযোগে। কিন্তু এই মূল্য কমানো সম্ভব। সচেতনতা, প্রশিক্ষণ ও উদ্যোগই পারে প্রবাসীর জীবনের গল্প বদলে দিতে। ভাষা শিখলেই খুলে যায় নতুন দরজা, সেই দরজার ওপারেই অপেক্ষা করছে সম্মান, নিরাপত্তা আর সফল প্রবাস জীবন।