স্বাস্থ্য

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক: বাড়ছে নীরব স্বাস্থ্যঝুঁকি

সাধারণ জ্বর–কাশি থেকে শুরু করে গুরুতর সংক্রমণ, সব রোগের ‘সহজ সমাধান’ হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। কিন্তু এই অভ্যাসই তৈরি করছে ভবিষ্যতের বড় স্বাস্থ্যসংকট।

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক এখন অনেকের কাছেই ‘ওভার-দ্য-কাউন্টার’ ওষুধ। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসি থেকে কিনে নেওয়া, আগের প্রেসক্রিপশন দেখে আবার খাওয়া বা পরিচিত কারও পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা- এসবই হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক অভ্যাস। কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার এই প্রবণতা ভবিষ্যতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিক কী এবং কখন প্রয়োজন

অ্যান্টিবায়োটিক মূলত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন-

  • নিউমোনিয়া

  • টাইফয়েড

  • কিছু ধরনের সংক্রমিত ক্ষত

কিন্তু-

  • সর্দি

  • কাশি

  • ভাইরাল জ্বর

  • ফ্লু বা কোভিডের মতো ভাইরাসজনিত রোগে

অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কার্যকারিতা নেই।

নিজে নিজে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রধান ঝুঁকিগুলো

১) অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স

সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স-যেখানে ব্যাকটেরিয়া ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।

ফলাফল-

  • সাধারণ সংক্রমণেও ওষুধ কাজ করে না

  • চিকিৎসা দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল হয়

  • মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে সাধারণ অপারেশনও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

২) ভুল রোগে ভুল ওষুধ

নিজে নিজে ওষুধ খেলে-

  • রোগের সঠিক কারণ নির্ণয় হয় না

  • ভাইরাল রোগে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার ফলে কোনো উপকার হয় না

  • প্রকৃত রোগ আড়ালে থেকে যায়

  • এর ফলে রোগ জটিল আকার নিতে পারে।

৩) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও অঙ্গক্ষতি

অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে-

  • ডায়রিয়া ও পেটের সমস্যা

  • অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন

  • লিভার ও কিডনির ক্ষতি

  • শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস

বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি।

৪) ওষুধের কোর্স অসম্পূর্ণ রাখা

অনেকেই কিছুটা ভালো লাগলেই অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দেন। এর ফলে-

  • সংক্রমণ পুরোপুরি সারে না

  • শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়া টিকে যায়

  • ভবিষ্যতে একই ওষুধ আর কাজ করে না

এটিও রেজিস্ট্যান্সের একটি বড় কারণ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে-

  • ফার্মেসিতে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়

  • সচেতনতার অভাব

  • স্বাস্থ্যসেবায় সহজ প্রবেশাধিকার না থাকায় মানুষ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে।

সচেতনতার করণীয়

  • ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করা

  • প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পুরো কোর্স সম্পন্ন করা

  • আগের প্রেসক্রিপশনের ওষুধ নতুন করে ব্যবহার না করা

  • ফার্মেসির পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া

  • অসুস্থ হলে নিকটস্থ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া

নীতিনির্ধারক ও সমাজের দায়িত্ব

  • অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ

  • গণসচেতনতামূলক প্রচারণা

  • ফার্মাসিস্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা

  • স্কুল পর্যায় থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা জোরদার করা

চূড়ান্ত কথা

অ্যান্টিবায়োটিক আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অমূল্য অর্জন। কিন্তু ভুল ও অতিরিক্ত ব্যবহারে এই শক্তিশালী অস্ত্রই আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। নিজের ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার অভ্যাস বন্ধ করাই হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।