স্বাস্থ্য

বোতলজাত পানি: নিরাপত্তার মোড়কে লুকিয়ে থাকা স্বাস্থ্যঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা দিতে বাজারে এসেছে বোতলজাত পানি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এই পানিই কি সত্যিই নিরাপদ, নাকি দীর্ঘমেয়াদে তৈরি করছে নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি?

নগরজীবনে নিরাপদ পানির বিকল্প হিসেবে বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। বাসা, অফিস, হাসপাতাল, এমনকি গ্রামের বাজারেও এখন বোতলজাত পানির সহজলভ্যতা চোখে পড়ে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা বলছে- এই পানির নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এখন সময়ের দাবি। বিশুদ্ধতার মোড়কে থাকা বোতলজাত পানি আদৌ কতটা স্বাস্থ্যসম্মত?

বোতলজাত পানির জনপ্রিয়তার কারণ-

  • পাইপলাইনের পানির মান নিয়ে অনাস্থা

  • নগর এলাকায় পানিবাহিত রোগের ভয়

  • ভ্রমণ ও অফিসজীবনে সহজ ব্যবহার

  • বিপণনে “বিশুদ্ধ”, “মিনারেল” শব্দের প্রভাব

কিন্তু জনপ্রিয়তা মানেই নিরাপত্তা, এই ধারণা ভ্রান্ত বলেই মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা।

১) প্লাস্টিক বোতল ও মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঝুঁকি

বেশিরভাগ বোতলজাত পানি PET (Polyethylene Terephthalate) প্লাস্টিকের বোতলে সংরক্ষিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে—

প্লাস্টিক বোতল থেকে পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মিশে যেতে পারে

উচ্চ তাপমাত্রায় (রোদে রাখা হলে) ক্ষতিকর রাসায়নিক নিঃসরণ বাড়ে

দীর্ঘদিন এসব কণা শরীরে জমে হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনো পুরোপুরি জানা না গেলেও এটি ক্যানসার, প্রজনন সমস্যা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

২) সব বোতলজাত পানি ‘মিনারেল ওয়াটার’ নয়

অনেক ভোক্তা মনে করেন বোতলজাত মানেই মিনারেল ওয়াটার। বাস্তবে.

  • অধিকাংশ বোতলজাত পানি পরিশোধিত (treated) পানি, প্রকৃত মিনারেল নয়

  • প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান (ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম) অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত

  • দীর্ঘদিন শুধুই এ ধরনের পানি পান করলে খনিজ ঘাটতি দেখা দিতে পারে

  • বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

৩) মান নিয়ন্ত্রণ ও ভেজাল সমস্যার বাস্তবতা

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে বোতলজাত পানির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো-

  • মান নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা

  • অনুমোদনহীন কারখানার অস্তিত্ব

  • ফিল্টার না করা পানি বোতলজাত করার অভিযোগ

কয়েকটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, কিছু ব্র্যান্ডের পানিতে-

  • অতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়া

  • অনুপযুক্ত pH মাত্রা

  • ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান

  • যা সরাসরি ডায়রিয়া, পেটের রোগ ও কিডনি সমস্যার কারণ হতে পারে।

৪) পরিবেশ দূষণ ও পরোক্ষ স্বাস্থ্যঝুঁকি

বোতলজাত পানির আরেকটি বড় প্রভাব পড়ে পরিবেশে-

  • ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল পুনর্ব্যবহার না হওয়া

  • মাটি ও পানিতে প্লাস্টিক দূষণ

  • খাদ্যশৃঙ্খলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রবেশ

পরিবেশ দূষণের এই প্রভাব শেষ পর্যন্ত মানবস্বাস্থ্যের ওপরই ফিরে আসে, বলছেন পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

৫) কখন বোতলজাত পানি প্রয়োজনীয়

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সব পরিস্থিতিতে বোতলজাত পানি ক্ষতিকর নয়। যেমন-

  • ভ্রমণের সময় নিরাপদ পানির অভাবে

  • দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে

  • হাসপাতাল বা জরুরি প্রয়োজনে

তবে নিয়মিত দৈনন্দিন পানির একমাত্র উৎস হিসেবে এটি ব্যবহার সতর্কতার সঙ্গে করা উচিত।

নিরাপদ বিকল্প ও সচেতনতার পরামর্শ

  • বাসায় ফুটানো ও ফিল্টার করা পানি পান করা

  • রোদে রাখা বোতলজাত পানি এড়িয়ে চলা

  • নির্ভরযোগ্য ও অনুমোদিত ব্র্যান্ড নির্বাচন

  • কাচের বোতল বা স্টিলের ফ্লাস্ক ব্যবহার

  • পানির মান সম্পর্কে লেবেল ভালোভাবে পড়া।

চূড়ান্ত কথা

বোতলজাত পানি আধুনিক জীবনের একটি বাস্তবতা। তবে অন্ধ নির্ভরতা নয়, প্রয়োজন সচেতন ব্যবহার। নিরাপদ পানির নামে যদি নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়, তাহলে সেই অভ্যাস পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। বিশুদ্ধতা শুধু বোতলে নয়—নিশ্চিত হতে হবে উৎস, প্রক্রিয়া ও ব্যবহারে।