স্বাস্থ্য

শিশুদের রাগ ও আচরণগত পরিবর্তন: মানসিক সংকেত

নিজস্ব প্রতিবেদক

হঠাৎ রাগ, জেদ বা আচরণ বদলে যাওয়া অনেক সময় ‘দুষ্টুমি’ নয়, এটি হতে পারে শিশুর মনের গভীর সংকটের ভাষা।

অনেক বাবা-মা অভিযোগ করেন, “আগে শান্ত ছিল, এখন একটু বললেই রেগে যায়”, “অকারণে চিৎকার করে, জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে।” বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব আচরণকে দুষ্টুমি বা শাসনের অভাব বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শিশু মনোবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের রাগ ও আচরণগত পরিবর্তন প্রায়ই মানসিক অস্বস্তি, ভয়, চাপ বা অব্যক্ত কষ্টের প্রকাশ। সময়মতো এসব সংকেত বুঝতে না পারলে সমস্যা গভীর হতে পারে।

শিশুর রাগ: স্বাভাবিক না উদ্বেগের কারণ?

রাগ মানুষের একটি স্বাভাবিক আবেগ। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে কিছু আচরণ সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা উচিত।

উদ্বেগজনক লক্ষণগুলো-

  • অল্পতেই অতিরিক্ত রাগ বা আক্রমণাত্মক আচরণ

  • বারবার কান্না বা নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া

  • খেলাধুলা বা পড়াশোনায় আগ্রহ কমে যাওয়া

  • ঘুম বা খাওয়ার অভ্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন

  • স্কুলে যেতে না চাওয়া বা ভয় পাওয়া

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই লক্ষণগুলো একসঙ্গে ও দীর্ঘদিন থাকলে তা মানসিক চাপ বা উদ্বেগের ইঙ্গিত হতে পারে।

আচরণগত পরিবর্তনের পেছনের কারণগুলো

১) পারিবারিক পরিবেশ

  • বাবা–মায়ের ঝগড়া বা বিচ্ছেদ

  • পরিবারে অতিরিক্ত শাসন বা অবহেলা

  • নতুন ভাইবোন আসা বা পরিবারের বড় পরিবর্তন

২) পড়াশোনার চাপ

  • অতিরিক্ত প্রত্যাশা ও ফলাফলের চাপ

  • পরীক্ষাভীতি

  • শিক্ষক বা সহপাঠীর সঙ্গে সমস্যা

৩) ডিজিটাল স্ক্রিন ও একাকিত্ব

  • অতিরিক্ত মোবাইল/ট্যাব ব্যবহার

  • শারীরিক খেলাধুলার অভাব

  • বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ কমে যাওয়া

৪) ভয় বা ট্রমা

  • বকুনি, অপমান বা শারীরিক শাস্তি

  • বুলিং

  • কোনো দুর্ঘটনা বা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা

  • শিশুরা কথা না বলে আচরণে প্রকাশ করে কেন

শিশুরা বড়দের মতো নিজের অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করতে পারে না। ফলে-

  • ভয় প্রকাশ পায় রাগে

  • দুঃখ প্রকাশ পায় জেদে

  • নিরাপত্তাহীনতা প্রকাশ পায় চুপচাপ হয়ে যাওয়ায়

মনোবিজ্ঞানীরা একে বলেন “Behavior is communication”, অর্থাৎ আচরণই শিশুর ভাষা।

বাবা–মায়ের সাধারণ ভুলগুলো

  • রাগকে ‘দুষ্টুমি’ ভেবে শাস্তি দেওয়া

  • শিশুর কথা না শুনে তুলনা করা

  • “এত রাগ কেন?” বলে তুচ্ছ করা

  • অনুভূতির বদলে শুধুই শাসনে জোর দেওয়া

এই ভুলগুলো শিশুর মানসিক সংকটকে আরও গভীর করে তোলে।

সঠিক করণীয়: বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

১) শুনুন, বিচার নয়

শিশু কী বলতে চাইছে, তা ধৈর্য নিয়ে শুনুন। কথা বলার সময় শাসন নয়, সহানুভূতি জরুরি।

২) অনুভূতির দাম দিন

“তুমি রেগে আছ”, “তুমি কষ্ট পেয়েছ”, এভাবে অনুভূতিকে স্বীকৃতি দিন।

৩) রুটিন ও নিরাপত্তা

নিয়মিত ঘুম, খাবার ও খেলার সময় শিশুকে মানসিক স্থিতি দেয়।

৪) স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন

খেলাধুলা, গল্প, পরিবারের সঙ্গে সময়, এসব মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

৫) প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সহায়তা

দীর্ঘদিন আচরণগত সমস্যা থাকলে শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

স্কুল ও সমাজের ভূমিকা

  • স্কুলে কাউন্সেলিং সুবিধা

  • শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ

  • বুলিং প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য শুধু পরিবারের নয়, সমাজেরও দায়িত্ব।

চূড়ান্ত কথা

শিশুর রাগ বা আচরণগত পরিবর্তন কোনো বিরক্তিকর সমস্যা নয়—এটি একটি সংকেত। এই সংকেত বুঝে সময়মতো পাশে দাঁড়াতে পারলেই গড়ে উঠবে মানসিকভাবে সুস্থ, আত্মবিশ্বাসী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। শাসন নয়, প্রয়োজন বোঝাপড়া ও সহানুভূতি।