স্বাস্থ্য

আমরা সবাই ক্লান্ত, কেনো বাড়ছে মানসিক চাপ?

মানসিক চাপের অদৃশ্য বোঝা গিলে খাচ্ছে তরুণ শক্তিকে

নিজস্ব প্রতিবেদক

মেধা, মনন নিয়ে চলাই গতিশীল জীবনের ধারাবাহিকতা। তবে লক্ষণীয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নানা ধরনের মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজ, প্রযুক্তির প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তাদের মানসিক সুস্থতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের জন্য পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ—সকল স্তরে সচেতনতা এবং সহায়তা প্রয়োজন।

পাশাপাশি, মানসিক চাপসমূহের মূল কারণ এবং প্রতিকারের প্রধান কিছু উপায়সমূহ আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন।

মানসিক চাপের প্রধান কারণসমূহ:

  • ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা:

    পড়াশোনা শেষ করে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ (career prospects) নিয়ে দেশীয়  তরুণদের মধ্যে গভীর হতাশা ও অনিশ্চয়তা কাজ করে। এই দুশ্চিন্তা তাদের মানসিক চাপের অন্যতম প্রধান কারণ।

  • শিক্ষা ব্যবস্থার চাপ:

    অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ, ভালো ফলাফলের প্রত্যাশা এবং পরীক্ষার ভীতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ (anxiety) সৃষ্টি করে। অনেক শিক্ষার্থী নিদ্রাহীনতা, মাথাব্যথা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় ভোগে।

  • সামাজিক ও পারিবারিক প্রত্যাশা:

    পরিবার এবং সমাজ প্রায়শই তরুণদের ওপর তাদের নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দেয়। এই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে তারা নিজেকে দোষী মনে করে এবং হীনম্মন্যতায় ভোগে।

  • সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব ও প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার: সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য, অন্যের সঙ্গে নিজের জীবনের তুলনা এবং ডিভাইসে আসক্তি তরুণদের মানসিক চাপের একটি বড় কারণ। প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের বাস্তব সামাজিক সম্পর্ক থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, যা একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি করে।

  • আর্থিক সংকট:

    পারিবারিক আর্থিক অনটন বা নিজস্ব অর্থনৈতিক দুর্বলতা তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়ায়। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছিল।

  • মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার (Stigma):

    মানসিক সমস্যাকে অনেকে এখনও দুর্বলতা বা পাগলামি মনে করে। ফলে রোগীরা তাদের সমস্যা লুকিয়ে রাখে এবং সময়মতো চিকিৎসা নিতে দ্বিধা বোধ করে।

  • সামাজিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্নতা:

    দ্রুত নগরায়ণ এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে তরুণরা ঐতিহ্যগত সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় তারা দিকনির্দেশনাহীনতায় ভোগে, যা মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে।

প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ধাপসমূহ (মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ):

  • উন্মুক্ত আলোচনা ও সহায়তা:

    পরিবারে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা (open discussion) উৎসাহিত করতে হবে। তরুণদের কথা শুনতে হবে এবং তাদের আশ্বস্ত করতে হবে যে সাহায্য চাওয়া কোনো লজ্জার বিষয় নয়।

  • সময় ব্যবস্থাপনা ও সুষম জীবনধারা:

    তরুণদের সময় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা শেখানো উচিত। প্রতিদিনের কাজে পড়াশোনার পাশাপাশি শারীরিক ব্যায়াম (physical exercise), পর্যাপ্ত ঘুম এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।

  • স্ক্রিন টাইম সীমিতকরণ:

    ভালো ঘুমের জন্য রাতে ডিজিটাল ডিভাইস (digital devices) ব্যবহার সীমিত করার পরামর্শ দেওয়া হয় এবং বাস্তব সামাজিক মেলামেশা (real-life interactions) বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে।

  • মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা:

    স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সেলরের (counselor) ব্যবস্থা করা জরুরি।

  • হবি বা শখের চর্চা:

    পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমে (co-curricular activities) অংশগ্রহণ তরুণদের মানসিক চাপ কমাতে এবং নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করতে পারে।

  • প্রশিক্ষিত পেশাদারদের সহায়তা:

    মানসিক চাপ যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন একজন বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসক বা মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। সাজিদা ফাউন্ডেশনের মতো কিছু সংস্থা টেলি-মেন্টাল হেলথ সার্ভিস (tele-mental health service) দিচ্ছে, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণদের জন্য সহায়ক হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ, পারিবারিক সচেতনতা এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।