আধুনিক কর্মজীবন: স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত
দেশের বড় শহরগুলোতে আধুনিক কর্মজীবন যত দ্রুতগতির হচ্ছে, ততই বাড়ছে এক অদৃশ্য চাপ—‘সাইলেন্ট স্ট্রেস’। অফিসের ভেতরে এটি চোখে দেখা যায় না, কারও মুখেও ধরা পড়ে না; তবুও নীরবে কর্মক্ষমতা, আচরণ, মনোযোগ ও মানসিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চাপটি মানুষ নিজেও বুঝতে পারে না প্রথমদিকে; কিন্তু একসময় এটি ঘুমের সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ, মনঃসংযোগ কমে যাওয়া ও ক্ষুধা–ওজনের পরিবর্তনের মতো উপসর্গ তৈরি করে।
অফিস পরিবেশ: নীরব চাপের তিন প্রধান উৎস-
১) অবিরাম টার্গেট ও মাইক্রো-ম্যানেজমেন্ট-
বেশিরভাগ অফিসেই এখন ‘পারফরম্যান্স কালচার’। প্রতিদিন টার্গেট, KPI, ডেডলাইন, সব মিলিয়ে কর্মীদের মধ্যে থাকে অবচেতন ভীতি। অনেকেই মনে করেন, একদিন কম পারফর্ম করলে চাকরির নিরাপত্তা কমে যাবে।
২) প্রযুক্তিনির্ভর কাজের অতিরিক্ত চাপ-
দু’ঘণ্টার কাজকে আধাঘণ্টায় নামিয়ে আনে অটোমেশন—কিন্তু এ সুবিধাই চাপ তৈরি করছে পাল্টা। দিনে ৮–১০ ঘণ্টা স্ক্রিন ব্যবহার, ক্রমাগত নোটিফিকেশন, মেইল-চ্যাট—মস্তিষ্কের ওপর বাড়তি চাপ ফেলছে।
৩) ব্যক্তিগত জীবনের সময় হারিয়ে যাওয়া-
হাইব্রিড ওয়ার্কিং কিংবা ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম বেশি নমনীয় হলেও ব্যক্তিগত সময়কে গ্রাস করছে। নিজের জন্য সময় না থাকায় মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে দ্রুত।
মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব-
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইলেন্ট স্ট্রেসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও জটিল:
দিনের শেষে মাথা ভারি লাগা
ঘুমাতে না পারা অথবা বারবার জেগে ওঠা
অকারণে রাগ ও হতাশা
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া
বার্নআউট ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা-
সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—এর বেশিরভাগই মানুষ নিজেরাও প্রথমদিকে টের পান না। ফলে চিকিৎসা বা পরিবর্তন আসে অনেক দেরিতে।
অবিরাম টার্গেট, কর্মীদের মধ্যে থাকে অবচেতন ভীতি
অফিসের ক্ষতি: কমছে উৎপাদনশীলতা-
কর্পোরেট পরিমণ্ডলে এখন দেখা যাচ্ছে "অ্যাক্টিভ উপস্থিতি কিন্তু নিষ্ক্রিয় মন", অর্থাৎ মানুষ অফিসে আসে ঠিকই, কিন্তু মনোযোগ বা শক্তি থাকে না। ফলে-
কাজের মান কমে যাচ্ছে
ভুলের হার বাড়ছে
টিমওয়ার্ক দুর্বল হচ্ছে
টার্নওভার বাড়ছে, নতুন কর্মী খোঁজার খরচ বাড়ছে
একটি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাইলেন্ট স্ট্রেস বর্তমানে উৎপাদনশীলতার অন্যতম বড় হুমকি।
কর্মীকে শুধু রিসোর্স নয়, মানুষ হিসেবে দেখা
সমাধানে কী করা জরুরি-
কর্মীদের জন্য:
প্রতিদিন অন্তত ১৫–২০ মিনিট ‘স্ক্রিন বিরতি’
সপ্তাহে ৩–৪ দিন মাঝারি ব্যায়াম
নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুম
অফিস–ব্যক্তিগত জীবনের সীমারেখা পরিষ্কার রাখা
কাজের চাপ বেশি হলে সরাসরি সুপারভাইজরকে জানানো
অফিস ব্যবস্থাপনার জন্য:
অপ্রয়োজনীয় মিটিং ও ইমেইল কমানো
নমনীয় কর্মঘণ্টা
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা কর্মশালা
প্রেশার-ফ্রি পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েশন
স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রাম
শেষ কথা-
সাইলেন্ট স্ট্রেস চোখে দেখা না গেলেও কর্মজীবী মানুষের মানসিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে দ্রুত। অফিসে উচ্চ প্রযুক্তি, ভালো বেতন বা আধুনিক ইন্টারিয়র থাকার পরেও কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য যদি নাজুক হয়, তবে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই এখনই সময়—কর্মীকে শুধু রিসোর্স নয়, মানুষ হিসেবে দেখার।