আন্তর্জাতিক

ব্রিকসের সম্প্রসারণ: পশ্চিমা নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ কি বাড়ছে?

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা শক্তিগুলো। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ন্যাটো কিংবা জি-৭, সবখানেই ছিল পশ্চিমাদের প্রভাব। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই একমুখী নেতৃত্বে ধীরে ধীরে ফাটল ধরছে।

এরই বড় প্রতীক হয়ে উঠেছে ব্রিকস জোটের সম্প্রসারণ।

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা  নিয়ে গঠিত ব্রিকস এখন আর কেবল একটি উন্নয়নশীল দেশের জোট নয়; বরং এটি ক্রমশ নিজেকে তুলে ধরছে পশ্চিমা আধিপত্যের বিকল্প শক্তি হিসেবে।

সম্প্রসারণের পেছনের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ব্রিকসের সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে আসেনি। ইউক্রেন যুদ্ধ, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব, সব মিলিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়েছে এক ধরনের মেরুকরণ। অনেক দেশই মনে করছে, পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা তাদের স্বার্থ যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে না।

এই প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো ব্রিকসকে দেখছে একটি বিকল্প কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ব্রিকস সেই আগ্রহকে বাস্তব রূপ দিয়েছে।

অর্থনীতিতে নতুন শক্তির সমীকরণ

ব্রিকস সম্প্রসারণের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য অর্থনীতিতে। নতুন সদস্য যুক্ত হওয়ার ফলে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো এখন বিশ্বের একটি বড় অংশের-

  • জ্বালানি সম্পদ

  • কাঁচামাল

  • জনসংখ্যা

  •  ভোক্তা বাজার

নিয়ন্ত্রণ করছে।

বিশ্ব জিডিপিতে ব্রিকসের সম্মিলিত অংশ ইতোমধ্যে জি-৭, এর কাছাকাছি পৌঁছেছে, কিছু ক্ষেত্রে ছাড়িয়েও গেছে। এটি পশ্চিমা অর্থনৈতিক নেতৃত্বের জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা।

ডলারের আধিপত্য প্রশ্নের মুখে

ব্রিকস সম্প্রসারণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ডি-ডলারাইজেশন বা ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য, বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম এবং ভবিষ্যতে যৌথ মুদ্রা ব্যবস্থার আলোচনা, সব মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে।

যদিও এই উদ্যোগগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব গভীর হতে পারে।

বিশেষ করে নিষেধাজ্ঞা রাজনীতিতে অভ্যস্ত পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য।

পশ্চিমাদের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া

ব্রিকসের সম্প্রসারণ পশ্চিমা বিশ্বে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিনির্ধারকরা প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও কূটনৈতিক বিশ্লেষণে স্পষ্ট যে, এই জোট ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পশ্চিমাদের প্রভাব কমাতে পারে।

তবে পশ্চিমা বিশ্ব এটাও মনে করে যে, ব্রিকসের ভেতরেই রয়েছে-

  • রাজনৈতিক মতপার্থক্য

  • অর্থনৈতিক অসমতা

  • ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা

এই অভ্যন্তরীণ বিভাজন জোটের কার্যকারিতা সীমিত করতে পারে।

ব্রিকসের চ্যালেঞ্জও কম নয়

ব্রিকসের সম্প্রসারণ যতটা সম্ভাবনাময়, ততটাই চ্যালেঞ্জিং।

সদস্য দেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা, উন্নয়নের স্তর এবং কৌশলগত স্বার্থ এক নয়।

উপরন্তু-

  • চীন ও ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা,

  • রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা,

  • কিংবা নতুন সদস্যদের নীতি সমন্বয়,

সবকিছু মিলিয়ে একটি কার্যকর ঐক্য গড়ে তোলা সহজ হবে না।

ভবিষ্যৎ কোন পথে?

ব্রিকসের সম্প্রসারণ কি পশ্চিমা নেতৃত্বের অবসান ঘটাবে? আপাতত নয়। তবে এটি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করছে যে, বিশ্ব আর একক নেতৃত্বে চলছে না। বিশ্বব্যবস্থা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে বহুমেরুকেন্দ্রিক বাস্তবতার দিকে, যেখানে পশ্চিমা শক্তির পাশাপাশি বিকল্প জোটগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ব্রিকস সেই পরিবর্তনেরই এক শক্তিশালী প্রতীক, যা পশ্চিমা বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে তাদের নেতৃত্ব, নীতি ও ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়ে।