বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে একটি ছোট ঘটনাও বড় যুদ্ধের সূত্র হয়ে উঠতে পারে। চীন–তাইওয়ান সংকট তেমনই এক বিপজ্জনক বিন্দু। দীর্ঘদিন ধরে চাপা থাকা এই উত্তেজনা এখন আর নীরব নয়, সামরিক মহড়া, কূটনৈতিক পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এবং শক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে তাইওয়ান প্রণালী ক্রমেই পরিণত হচ্ছে বৈশ্বিক উদ্বেগের কেন্দ্রে।
এই সংকট শুধু দুটি পক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ পুরো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ।
সংকটের ঐতিহাসিক শিকড়
চীন-তাইওয়ান দ্বন্দ্বের সূচনা গত শতকের মাঝামাঝি। চীনের গৃহযুদ্ধ শেষে মূল ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও পরাজিত পক্ষ তাইওয়ানে আশ্রয় নেয়। তখন থেকেই চীন তাইওয়ানকে নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে আসছে। অন্যদিকে, সময়ের সঙ্গে তাইওয়ান নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থা, গণতন্ত্র ও আলাদা পরিচয় গড়ে তোলে।
এই দুই অবস্থানের সংঘাতই আজকের উত্তেজনার মূল। বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে তাইওয়ান প্রশ্ন জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিষয়, আর তাইওয়ানের কাছে এটি অস্তিত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার নতুন মাত্রা
গত কয়েক বছরে চীন তার সামরিক শক্তি দ্রুত বাড়িয়েছে। নিয়মিতভাবে তাইওয়ান প্রণালী ও আকাশসীমার আশপাশে সামরিক মহড়া, যুদ্ধবিমান ও নৌবহরের উপস্থিতি তাইওয়ানের নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এসব মহড়া কেবল প্রশিক্ষণ নয়, এগুলো একটি রাজনৈতিক বার্তাও বহন করে: প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের সক্ষমতা চীনের আছে।
তাইওয়ানও পাল্টা প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানো, সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং জরুরি প্রতিক্রিয়া সক্ষমতা জোরদার করার মাধ্যমে দ্বীপটি সম্ভাব্য যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার বার্তা দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও কূটনৈতিক জটিলতা
চীন-তাইওয়ান উত্তেজনায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে সবচেয়ে স্পর্শকাতর। একদিকে ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, অন্যদিকে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে।
এই দ্বৈত অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বেইজিংয়ের কাছে তা স্পষ্ট উসকানি হিসেবে ধরা পড়ে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যতই তাইওয়ানের পাশে দাঁড়াচ্ছে, ততই চীনের সঙ্গে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ছে- যা পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে প্রভাব
চীন-তাইওয়ান সংঘাতের সম্ভাব্য প্রভাব শুধু দুই পক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর নিরাপত্তা নীতিতে এই উত্তেজনা ইতোমধ্যেই প্রভাব ফেলছে। কারণ তাইওয়ান প্রণালী একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ, যার ওপর নির্ভর করে বৈশ্বিক বাণিজ্যের বড় অংশ।
যুদ্ধ শুরু হলে এই রুট ব্যাহত হবে, সরবরাহ ব্যবস্থায় ধাক্কা লাগবে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ঝুঁকির মুখে পড়বে।
প্রযুক্তি ও অর্থনীতির ঝুঁকি
তাইওয়ান বিশ্ব প্রযুক্তি শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, বিশেষ করে আধুনিক চিপ উৎপাদনে। এই দ্বীপে অস্থিরতা তৈরি হলে স্মার্টফোন থেকে শুরু করে সামরিক সরঞ্জাম, সবকিছুর উৎপাদন ও সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
এই কারণেই চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা কেবল সামরিক বা রাজনৈতিক ইস্যু নয়; এটি সরাসরি বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত।
যুদ্ধ কি অনিবার্য?
বিশ্লেষকদের বড় অংশ মনে করেন, কেউই সরাসরি যুদ্ধ চায় না। কারণ যুদ্ধের মূল্য এত বেশি যে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তবে সমস্যাটি হলো- ভুল হিসাব, অতিরিক্ত শক্তি প্রদর্শন কিংবা আকস্মিক সংঘর্ষ পরিস্থিতিকে মুহূর্তেই বদলে দিতে পারে।
আজকের বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় ঝুঁকি পরিকল্পিত যুদ্ধ নয়, বরং অনিচ্ছাকৃত সংঘাত।
সামনে কী?
চীন-তাইওয়ান সংকট এখন এক ধরনের পরীক্ষার মুখে, কূটনীতি কি শেষ পর্যন্ত সামরিক শক্তিকে থামাতে পারবে? নাকি শক্তির ভাষাই শেষ কথা হয়ে উঠবে?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অনিশ্চিত। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তাইওয়ান প্রণালীর যে কোনো অস্থিরতা শুধু এশিয়া নয়, পুরো বিশ্বের ভবিষ্যৎ গতিপথে গভীর ছাপ ফেলবে। আর সেই কারণেই এই সংকটকে আর ‘আঞ্চলিক ইস্যু’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।