পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র ও সেগুলোর বিস্তার নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও স্নায়ুচাপের অনুভূতি একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। সম্প্রতি অবমুক্ত হওয়া কথোপকথনের হুবহু ট্রান্সক্রিপ্টে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভ এই সপ্তাহে নথিগুলো প্রকাশ করে। তথ্য অধিকার আইন (FOIA), এর আওতায় করা একটি মামলার পর এসব নথি প্রকাশ করা হয়। এতে ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পুতিন ও বুশের বিভিন্ন বৈঠক ও ফোনালাপের বিবরণ রয়েছে। নথিগুলোতে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র এবং সেগুলো ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে দুই নেতার গভীর উদ্বেগ স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
নথি অনুযায়ী, সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের অধীনে থাকা পাকিস্তানকে উভয় নেতা একটি বড় পারমাণবিক বিস্তার–সংক্রান্ত সমস্যা হিসেবে দেখতেন। যদিও ৯/১১ পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ অংশীদার ছিলর
২০০১ সালের ১৬ জুন স্লোভেনিয়ার ব্রদো ক্যাসেলে প্রথম সরাসরি বৈঠকে পুতিন পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা নিয়ে খোলাখুলি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বুশকে বলেন,
“আমি পাকিস্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন। এটি মূলত পারমাণবিক অস্ত্রধারী একটি জান্তা সরকার। এটি কোনো গণতন্ত্র নয়, তবু পশ্চিমা বিশ্ব একে সমালোচনা করে না। এ নিয়ে কথা বলা উচিত।”
এই আলোচনা হয় কৌশলগত স্থিতিশীলতা, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং ন্যাটো সম্প্রসারণ ইস্যুর প্রেক্ষাপটে। বুশ তখন বলেন, রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বেরই অংশ এবং কোনো শত্রু নয়। এই সময়েই দুই নেতার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যার প্রতিফলন পরে বুশের সেই বহুল আলোচিত মন্তব্যে, যেখানে তিনি বলেন, পুতিনের “আত্মার দিকে তাকিয়ে” তাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে এক বৈঠকে পাকিস্তানের পারমাণবিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনা আরও স্পষ্ট হয়। ওই বৈঠকে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা হয়।
২০০৫ সালের কথোপকথনের অংশবিশেষ:
পুতিন:
“ইরানে কী ধরনের গবেষণাগার আছে, কোথায় আছে, সব পরিষ্কার নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতা এখনো আছে।”
বুশ:
“আমি মোশাররফের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। আমি তাকে জানিয়েছি, ইরান ও উত্তর কোরিয়ায় প্রযুক্তি পাচারের বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। তারা এ কিউ খানকে এবং তার কিছু সহযোগীকে গৃহবন্দি করেছে। আমরা জানতে চাই তারা কী বলেছে। আমি বারবার মোশাররফকে এ কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি, হয় সে আমাদের কিছুই দিচ্ছে না, নতুবা পুরো সত্য বলছে না।”
পুতিন:
“আমার বোঝা মতে, সেন্ট্রিফিউজে পাকিস্তানি উৎসের ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে।”
বুশ:
“হ্যাঁ, যেটা ইরান আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) কে জানাতে ভুলে গিয়েছিল। এটা স্পষ্ট লঙ্ঘন।”
পুতিন:
“ওটা পাকিস্তানি উৎসের। এটা আমাকে নার্ভাস করে তোলে।”
বুশ:
“আমাদেরও নার্ভাস করে।”
পুতিন:
“আমাদের কথাও ভাবুন।”
বুশ:
“আমাদের আরও ধর্মীয় উগ্রবাদী হাতে পারমাণবিক অস্ত্রের দরকার নেই। ইরানে এখন তারাই দেশ চালাচ্ছে।”
এই খোলামেলা কথোপকথনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কুখ্যাত এ কিউ খান নেটওয়ার্ক নিয়ে দুই নেতার যৌথ উদ্বেগ। পাকিস্তানের এই বিজ্ঞানী একাধিক দেশে পারমাণবিক প্রযুক্তি বিক্রির কথা স্বীকার করেছিলেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিয়েও তাদের শঙ্কা ছিল।
নথিগুলোতে ৯/১১ পরবর্তী সময়ে পুতিন ও বুশের মধ্যে গড়ে ওঠা এক ধরনের ‘ফক্সহোল বন্ধুত্বের’ চিত্রও উঠে এসেছে। সন্ত্রাসী হামলার পর বুশ পুতিনকে বলেছিলেন,
“ফক্সহোলে আমি যাদের পাশে চাই, পুতিন সেই ধরনের মানুষ।”
এই নথিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NARA) প্রক্রিয়াজাত করে প্রকাশ করে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভ, জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, NARA-র বিরুদ্ধে FOIA মামলা করায় এই অবমুক্তকরণ ত্বরান্বিত হয়।
পাকিস্তানের পারমাণবিক বিস্তার নিয়ে ভারতের উদ্বেগ:
পাকিস্তানের পারমাণবিক বিস্তার নিয়ে ভারতের উদ্বেগ নতুন নয়। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তান গোপনে পারমাণবিক পরীক্ষা চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করলে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল (নভেম্বর ২০২৫) বলেন,
“গোপন ও অবৈধ পারমাণবিক কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের ইতিহাসের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ, যে ইতিহাস চোরাচালান, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ লঙ্ঘন, গোপন অংশীদারিত্ব এবং এ কিউ খান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিস্তারের সঙ্গে যুক্ত।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক স্বচ্ছতার অভাব এবং বিস্তারমূলক কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের দীর্ঘদিনের উদ্বেগের বিষয়।
এদিকে মে মাসের সংঘাতের পর ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি পাকিস্তানকে একটি “দায়িত্বজ্ঞানহীন ও দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র” হিসেবে আখ্যা দিয়ে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) তত্ত্বাবধানে আনার আহ্বান জানান।