ইসরায়েলি সেনারা গাজার উদ্দেশ্যে যাওয়া একটি সহায়তা বহর (ফ্লোটিলা) আটক করেছে। এতে শত শত যাত্রীকে আটক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গও। ফ্লোটিলার আয়োজকরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
গ্লোবাল সমুদ ফ্লোটিলা (জিএসএফ) নামের এই বহরটি গত ১৮ বছর ধরে চলা ইসরায়েলের অবরোধ ভেঙে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। জাহাজগুলো ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। আয়োজকদের দাবি, ৪২টি জাহাজের মধ্যে ৪১টিই ইসরায়েল আটক করেছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত একটি জাহাজ অবরুদ্ধ না হয়ে সমুদ্রে ছিল। মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘প্ররোচনামূলক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে শেষ একটি জাহাজ এখনো দূরে রয়েছে। এটি কাছে এলে ব্লকেড ভাঙার চেষ্টা প্রতিহত করা হবে।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, ইহুদি ধর্মীয় উৎসব ইয়োম কিপুর চলাকালে ৪১টি জাহাজের বড় ধরনের অনুপ্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ করা হয়। এতে অংশ নেওয়া ৪০০ জনকে নিরাপদে বন্দরে নিয়ে গিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ সেনাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী ফ্লোটিলা প্রতিহত করার জন্য আইডিএফকে ধন্যবাদ।’ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও সেনাদের প্রশংসা করে বলেন, ‘তাদের গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের চেষ্টা ঠেকানো হয়েছে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বৈধতা নষ্ট করার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।’
অন্যদিকে আয়োজকরা ইসরায়েলের পদক্ষেপকে ‘নিরস্ত্র মানবিক কর্মীদের ওপর অবৈধ হামলা’ বলে উল্লেখ করেছেন। ইসরায়েল বলেছে, এই কর্মীরা প্রকৃতপক্ষে সহায়তায় নয়, বরং প্ররোচনায় আগ্রহী।
আয়োজকদের দাবি, স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় গাজা উপকূল থেকে ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে প্রথম জাহাজ আটক করা হয়। জিএসএফ বলেছে, একটি জাহাজকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেওয়া হয় এবং আরও দুটি জাহাজকে পানির কামান দিয়ে টার্গেট করা হয়। তারা একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে ইউলারা নামের জাহাজকে পানির কামান দিয়ে আঘাত করতে দেখা যায়।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আটক যাত্রীদের দেশে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং সেখান থেকে তাদের ইউরোপে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।
তারা আরও বলেছে, ‘গ্রেটা ও তার সহযাত্রীরা নিরাপদে আছেন।’ সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, গ্রেটা থানবার্গ মেঝেতে বসে আছেন এবং চারপাশে সামরিক সদস্যরা রয়েছেন।
ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নিন্দা দেখা দিয়েছে। ইতালি ও তুরস্কে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। বিভিন্ন দেশের নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এই ঘটনাটি এমন সময় ঘটল যখন মাত্র কয়েকদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে মিলে গাজার যুদ্ধ থামানোর শান্তি প্রস্তাব ঘোষণা করেছিলেন।
এই ফ্লোটিলায় ৫০০-র বেশি অংশগ্রহণকারী ছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন স্পেন ও ইতালির সংসদ সদস্যরাও। তারা খাদ্য, পানি ও ওষুধ গাজার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছিলেন। বহরটি গত ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে যাত্রা শুরু করে। পথে বিভিন্ন ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর থেকে আরও জাহাজ এতে যুক্ত হয়।
গ্রেটা থানবার্গ এর আগেও জুন মাসে গাজার উদ্দেশ্যে যাওয়া আরেকটি জাহাজে ছিলেন, সেটিও ইসরায়েল আটক করে তাকে বহিষ্কার করেছিল।
প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে গাজার অবস্থা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ সমর্থিত সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার কিছু এলাকায় এখন ‘মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ’ চলছে।
ব্রিটিশ চিকিৎসক জেমস স্মিথ, যিনি আগেও ফ্লোটিলায় অংশ নিয়েছিলেন, সিএনএনকে বলেন, ‘এই ফ্লোটিলা শুধু মানবিক সহায়তা বহন করছে না, বরং এটি সরাসরি পদক্ষেপ, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।’
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বহরকে বারবার জানানো হয়েছিল তারা যেন দিক পরিবর্তন করে। তাদের বলা হয়, তারা সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগোচ্ছে এবং বৈধ নৌ অবরোধ ভঙ্গ করছে।
তবে আয়োজকেরা বলেছেন, তারা সহায়তা কোনো তৃতীয় পক্ষকে দেবেন না; সরাসরি গাজার সাধারণ মানুষের কাছেই পৌঁছাতে চান।
এর আগে জিএসএফ জানিয়েছিল, তাদের কিছু জাহাজে ইসরায়েলি ড্রোন হামলা চালায়, যার পর ইতালি ও স্পেন নিজেদের জাহাজ পাঠায় ফ্লোটিলাকে সাহায্য করতে।
ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা গাজা থেকে এমন নথি পেয়েছে যা প্রমাণ করে হামাস সরাসরি এই ফ্লোটিলার অর্থায়ন ও পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত। তবে জিএসএফ এসব অভিযোগকে ‘প্রচার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্লোটিলাকে ‘অপ্রয়োজনীয় প্ররোচনা’ বলে উল্লেখ করেছে। তবে ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে।
ইতালি, তুরস্ক, গ্রিস, তিউনিসিয়া ও আর্জেন্টিনায় ফ্লোটিলা সমর্থনে বিক্ষোভ হয়েছে। ইতালির বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভের পাশাপাশি দেশটির শ্রমিক ইউনিয়ন শুক্রবার জাতীয় ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেইনবাম জানিয়েছেন, আটক জাহাজে ছয়জন মেক্সিকান নাগরিক রয়েছেন এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যেই চার দফা কূটনৈতিক বার্তা পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘মানবিক সহায়তা গাজায় পৌঁছাতে হবে এবং আমাদের নাগরিকদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনা উচিত, কারণ তারা কোনো অপরাধ করেনি।’
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনাটিকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বলে আখ্যা দিয়েছে। হামাস একে ‘বিশ্বাসঘাতক হামলা ও জলদস্যুতা’ বলেছে। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো একে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং ইসরায়েলি কূটনীতিকদের বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ নোয়েল ব্যারো ইসরায়েলকে অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানিয়েছেন। ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি বলেছেন, বিষয়টির সমাধান ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই হওয়া উচিত।
এর আগে বিভিন্ন সময় গাজায় সহায়তা নিয়ে যাওয়া বহর আটক বা আক্রান্ত হয়েছে। জুন মাসেও গ্রেটা থানবার্গকে বহনকারী একটি বহর আটক করে ইসরায়েল। মে মাসে আরেকটি বহরকে আন্তর্জাতিক সমুদ্রে ড্রোন হামলার মুখে পড়তে হয়েছিল।
২০১০ সালে এক প্রাণঘাতী ঘটনায় ইসরায়েলি সেনারা আন্তর্জাতিক সমুদ্রে একটি ফ্লোটিলায় হামলা চালায়, যাতে নয়জন তুর্কি নাগরিক নিহত হয়। পরে আরও একজন আহত হয়ে ২০১৪ সালে মারা যান।
সূত্র:সিএনএন