কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার 
লাইফস্টাইল

গ্রামীণ জীবনে প্রযুক্তির ছোঁয়া! আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?

প্রযুক্তিতে বদলে যাচ্ছে চিরায়ত গ্রামীণ জীবন

জান্নাতুন নাঈম

চার দশক আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য অনেক। দেশ বদলেছে, জীবন বদলেছে। সেই বদলের ছোঁয়া লেগেছে গ্রামীণ জীবনেও। সত্তরের দশকে অজপাড়াগাঁ বলতে যা বোঝাত, তা এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রত্যন্ত, দুর্গম এলাকার গ্রামও এখন পাকা সড়ক দিয়ে সংযুক্ত হয়েছে শহরের সঙ্গে। যে গ্রামে সব ঘরে কুপি বাতিও জলত না প্রয়োজনীয় তেলের অভাবে, এখন সেখানে হয় পল্লী বিদ্যুৎ নয়তো সৌর বিদ্যুতের আলো ঝলমল করে। যে গ্রামে ডাকে চিঠি, টেলিগ্রাম, মানি অর্ডার পৌঁছাতে অনেক দিন লেগে যেত, সেই গ্রামেও আছে এখন মোবাইল ফোনের কাভারেজ, বিকাশের মাধ্যমে মুহূর্তেই প্রিয়জনের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার সুযোগ। গ্রামে এখনও দারিদ্র্য আছে; কিন্তু না খেয়ে থাকা মানুষ আর নেই। এখনও আঁতুড়ঘরে সদ্যোজাত শিশু শেষ চিৎকার দিয়ে চিরবিদায় নেয়, তবে তার সংখ্যা অনেক কম। গ্রামের শিশু-কিশোরদের এখনও বাবার সঙ্গে লাঙ্গল ধরতে হয়, তবে বিদ্যালয় থেকে ফিরে। রোগ-শোক-জরা আছে, সেই সঙ্গে আছে চিকিৎসার ব্যবস্থাও। জীবন বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে এখনও শহরে যায় গ্রামের বহু তরুণ-তরুণী, তবে সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন এখন গ্রামে থেকেও দেখা যায়। শুধু হাডুডু, নৌকাবাইচ নয়; গ্রামের ছেলেটি এখন ওয়ার্ল্ড ক্রিকেটের সব খবরাখবর রাখে, সে জানে লা লিগার বার্সোলোনা বনাম রিয়াল মাদিদ ম্যাচেরও খবরাখবর। গ্রামের অনেক বাড়িতেই এখন রয়েছে ডিশ লাইনের সংযোগ। যার সুবাদে তারা ভারতীয় হিন্দি,বাংলা জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের নিয়মিত দর্শক।

পালাবদল ঘটেছে গ্রামীণ অবকাঠামোতে, খাদ্যের প্রাপ্যতায়, জীবনযাত্রার মানে, যোগাযোগ ব্যবস্থায়, শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যে। কুঁড়েঘরের জায়গায় এসেছে টিনের ঘর। প্রায় প্রতি বাড়িতেই রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা। কলেরা বসন্তের মতো মহামারি বিদায় নিয়েছে। আগে যেখানে হাঁটা কিংবা নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না, এখন গ্রামের মানুষ হরদম যন্ত্রচালিত বাহনে চড়ে। শুধু ভাত আর ডাল নয়; পাতে সবজি, মাছ-মাংসও থাকে এখন। এক বেলা নয়, বেশির ভাগ মানুষই এখন তিন বেলা ভরপেট খেয়েই বেঁচে থাকে। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে জীবনটাকে নষ্ট করে দিতে রাজি নন বেশিরভাগ বাবা-মা। বাল্যবিয়ের হার কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে।

আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দিনে দিনে দ্রুত গ্রামীণ অর্থনীতিতে চেহারা বেমালুম পাল্টে যাচ্ছে। কৃষির বাইরেও দেশের মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের ৭১ শতাংশই এখন গ্রামে। শুধু কৃষিকাজ নয়, গ্রামের মানুষ এখন বহু ধরনের পেশায় নিজেদের যুক্ত করে জীবন বদলে দিচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও চলে গেছে ব্যাংকের সেবা। উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছে গ্রামের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাও। গ্রাম মানেই এখন আর কৃষি কাজ নয়। কৃষিবহির্ভূত কাজ গ্রাম থেকে শহরে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। এক দশক আগেও বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অবস্থা এখনকার মতো ততটা চাঙ্গা ছিল না। তখন শহরের অর্থনীতি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য ছিল। অভাব, দুঃখ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অজ্ঞতা, পশ্চাৎমুখী সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের অচলায়তন সৃষ্টি করে রেখেছিল। বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের গাঝাড়া মনোভাব লক্ষ করা যায় খুব সহজেই। বলা যায়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নবজাগরণ এসেছে। যার ফলশ্রুতিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। এতে করে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে গেছে আগের তুলনায়। বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামের সাধারণ কৃষক শ্রেণির ভাগ্য বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। গ্রামীণ অর্থনীতি বর্তমানে খুবই চাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে। কৃষি খাতে তো অবস্থা ভালোই, এমনকি কৃষির বাইরেও গ্রামীণ অর্থনীতি বর্তমানে চমৎকার ভালো অবস্থায় রয়েছে। গ্রামীণ জনগণের মধ্যে এখন কৃষির পাশাপাশি ছোট ছোট শিল্প স্থাপনের প্রতি আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে।

হাঁস-মুরগির পোলট্রি ফার্ম থেকে শুরু করে মৎস্য চাষ এমনকি গাড়ির বডি পর্যন্ত এখন গ্রামে তৈরি হচ্ছে। গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে গত কয়েক দশকে। গ্রামের কৃষি এখন আর সেই সনাতনী অবস্থায় পড়ে নেই। গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ হচ্ছে। আগে যেখানে অনেক জমি চাষাবাদের আওতার বাইরে থেকে যেত, বছরে একটি মাত্র ফসল উৎপাদনের পর বাকি সময়টা অব্যবহৃত অবস্থায় রয়ে যেত, এখন সেখানে বছরজুড়ে পালাক্রমে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। অব্যবহৃত অবস্থায় কোনো জমিই খালি পড়ে থাকছে না। ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে এখন প্রতিটি কৃষক নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। উচ্চফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহার থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক প্রয়োগ, আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ আগের তুলনায় অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলেছেন গ্রামের কৃষক। এক দুই দশক আগেও গ্রামীণ কৃষি জমিতে গরু মহিষ দিয়ে হাল চাষের ব্যবস্থা করতেন যে কৃষক, এখন সেই কৃষক অনায়াসেই ট্রাক্টর দিয়ে কৃষি জমিতে কর্ষণ করছেন, বীজ বুনছেন, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। গতানুগতিক পুরোনো চাষাবাদ পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয় এযুগে, এটা গভীরভাবে উপলব্ধির পর এখন বেশিরভাগ গ্রামের কৃষক যুগোপযোগী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে চাষাবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। অতীতে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজে সেচ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল ছিল। প্রকৃতির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল থাকতে হতো। বৃষ্টির পানি নয়তো খাল-বিল-নদীর পানি জমিতে প্রয়োগের মাধ্যমে চাষাবাদ করতে হতো। অথচ এখন প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে বৈদ্যুতিক গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে চাষাবাদের চমৎকার সুযোগ। এটা যদিও ব্যয়বহুল, তারপরও কৃষি উৎপাদনে ধারাবাহিকতা, নিরবিচ্ছিন্ন ভাব বজায় রাখতে কৃষি জমিতে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সেচ স্কিমের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন গ্রামের মানুষ। এভাবেই গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা প্রতিষ্ঠান। সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকা-ও বেড়ে গেছে। সরকারি কৃষি কর্মকর্তারা আগে অনেকটা অলস সময় কাটালেও এখন তাদেরকে গ্রামে গ্রামে কৃষকের কাছে নিয়মিত ছুটে যেতে দেখা যাচ্ছে। তাদের বুদ্ধি, পরামর্শ এবং গঠনমূলক উপদেশ গ্রামের কৃষকদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণে। স্রেফ কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন নয়, এর পাশাপাশি হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ তাদের ভাগ্য উন্নয়নে পুরোপুরি সচেষ্ট বলা যায়। আজকাল প্রায় প্রতিটি গ্রামেই হাঁস-মুরগির খামার, দুগ্ধ উৎপাদনকারী ডেইরি ফার্ম, মৎস্য চাষ প্রকল্পের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ। আগে স্রেফ ধান, পাট, শাকসবজি, শস্য উৎপাদনের মধ্যেই গ্রামের মানুষ তার কর্মকা- সীমাবদ্ধ রাখতেন। এর বাইরে অন্য কোনো কাজের কথা তারা ভাবতে পারতেন না। কৃষি কাজের পর বাকি সময়টা তারা অলস, বেকার বসে কাটাতেন। এখন তারা তাদের প্রতিটি মুহূর্ত নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজে ব্যয় করছেন। মাঠে কৃষি কাজের পাশাপাশি গ্রামের মানুষ পোলট্রি ফার্ম ও ডেইরি ফার্মেও প্রয়োজনীয় সময় দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে উপার্জনের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে গ্রামাঞ্চলে। গ্রামের পোলট্রি ফার্মে উৎপাদিত হাঁস-মুরগি ও ডিম বাজারজাত করতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। মানুষ নিজের পালিত মুরগির চেয়ে বাজার থেকে কেনা ব্রয়লার মুরগিই বেশি খাচ্ছে। শুধু আম আর কাঁঠাল নয়, গ্রামে এখন ফলন হচ্ছে বাউকুল, স্টবেরি, ড্রাগন ফলের মতো বিদেশি নতুন অনেক ফল। শুধু লাউ-কুমড়া নয়, গ্রামের কৃষক এখন ক্যাপসিকাম, গ্রীষ্মের টমেটো ফলানোর মতো নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি আয়ত্বে এনেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন প্রত্যন্ত অনেক গ্রামের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য, পোলট্রি শিল্পের উৎপাদিত ডিম, হাঁস-মুরগি এবং ডেইরি ফার্মে উৎপাদিত দুধ খুব দ্রুতই শহরে পৌঁছে যাচ্ছে। উৎপাদনকারী কৃষক ও খামারি তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পেয়ে যাচ্ছেন সহজেই, খুব কম সময়ের মধ্যেই। মধ্যস্বত্বভোগী দালাল ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য আগের মতো না থাকায় এখন উৎপাদনকারী কৃষক, খামারিরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন। অতীতে তারা কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেতেন না কোনোভাবেই। নানা বঞ্চনা আর শোষণের বেড়াজালে তাদেরকে আজীবন বন্দি থাকতে হতো।

স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েক দশক ধরে শহরের অর্থনীতি ও গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে বিরাট ব্যবধান খুব সহজেই চোখে পড়ত। তখনও গ্রামের মানুষের জীবনযাপন ছিল নিতান্তই দারিদ্র্য, অভাব আর অসচ্ছলতার সমন্বিত প্রকাশ। তখন গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ দারুণ অর্থসংকট এবং চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করতেন। নিত্য অভাব-অনটনের মধ্যে তাদের জীবন কাটত। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি হওয়ার কারণে অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে তাদের ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হতো। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা তাদের জন্য সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ কম হওয়ায় কৃষক সবসময় দুঃখ-দৈন্যের দুষ্টচক্রের মধ্যে বন্দি থাকতেন। কিন্তু এখন বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামের চিত্র পাল্টে গেছে। উন্নত আধুনিক প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে অনেক। বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম হওয়ায় ফসলের তেমন ক্ষতি হচ্ছে না। বন্যা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করায় আগের মতো বন্যা ততটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারছে না গ্রামের মানুষকে। সব কিছু মিলিয়ে গ্রামের কৃষক ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত মানুষদের জন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকায় তাদের আর্থিক সচ্ছলতা ক্রমেই বাড়ছে। এখন আর তাদেরকে তেমন অর্থকষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে না। গত দুই দশকে বিভিন্ন এনজিওর উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে নানা ধরনের প্রকল্প চালু হওয়ায় গ্রামের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা নানা কাজে সম্পৃক্ত হয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার সৃষ্টি করেছে। আজকাল গ্রামাঞ্চলে তরুণ, যুবক, যুবতীরা নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছেন। তাদের এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে মুরগির খামার, কৃষি খামার, উন্নতজাতের গাভি পালনের মাধ্যমে দুগ্ধ উৎপাদন খামার, মৎস্য খামার, মৌমাছি চাষের মাধ্যমে মধু উৎপাদন, ফুল ও ফলের বাগানসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে একথা না মেনে উপায় নেই। চাকরির আশায় বসে না থেকে নিজস্ব উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের অনেকেই সংসারের জন্য উপার্জন করছেন। তাদের উপার্জনে সংসার চলছেÑ এমন তরুণ-তরুণী উদ্যোক্তার সংখ্যাও কম নয়। তারা শিক্ষিত এবং আধুনিক বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় গ্রামে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল মজুদদারদের কাছে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি না করে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে শহরে নিয়ে বিক্রি করছেন। এতে তারা ভালো দাম পাচ্ছেন এবং আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমোন্নতি বিরাট ভূমিকা পালন করছে। গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগাযোগ আজকাল সহজসাধ্য হওয়ায় গ্রামে উৎপাদিত কৃষিজাত ও শিল্পজাত পণ্য শহরের ক্রেতাদের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে খুব সহজে কম সময়ের মধ্যে।

এখন এনজিও এবং অন্যান্য দেশি-বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় গ্রামাঞ্চলে স্বল্প পুঁজির নারী উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তারা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে গ্রামের কর্মহীন নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন। গ্রামের মহিলারা এসব উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাড়তি আয়ের মাধ্যমে সংসারের সচ্ছলতা আনছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে গ্রামের অনেক মানুষ এখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উপার্জন করছেন। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতি গত কয়েক দশকে বেশ চাঙ্গা হয়েছে, এটা না মেনে উপায় নেই। এখন গ্রামে গ্রামে নির্মিত হচ্ছে কয়েক তলা পাকা ভবন। যেখানে বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে শুরু করে শহুরে জীবনের মতো উন্নত নানা সুযোগ-সুবিধা থাকছে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে গ্রামীণ জীবনযাপনে আধুনিকতার ছাপ ক্রমেই সুস্পষ্ট হচ্ছে। এর মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনের চেহারাটাই বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। এখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে মেধা ও যোগ্যতার বলে জীবনে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তারা শহরের বড় বড় পদে চাকরি করছে। বড় বড় ব্যবসায় নিয়োজিত হচ্ছে। তারাও গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করছে।

গ্রামের অর্থনীতির পরিবর্তনটি চোখে পড়ে বাজারের কোনো মুদি দোকানে গেলেই। সেখানে এখন শুধু চাল, ডাল আর কেরোসিন তেলই নয়, বিক্রি হয় শ্যাম্পু, সুগন্ধি সাবানসহ প্রসাধন সামগ্রীও। গ্রামের মানুষ এখন আর কাঠকয়লা দিয়ে দাঁত মাজে না, মাজে টুথপেস্ট ব্রাশ দিয়ে কিংবা নিদেনপক্ষে টুথ পাউডার দিয়ে। চিপস, কোল্ড ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস, ফ্রুট ড্রিংকসÑ এমনকি মিনারেল ওয়াটারও পাওয়া যায় গ্রামের বাজারের দোকানে। বিভিন্ন বাড়িতে রয়েছে মোটরসাইকেল। মেয়েরাও অনেক গ্রামে সাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজে যায়। দেশের ১৪ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহকের বড় অংশ গ্রামের মানুষ। তাদের কেউ কেউ স্কাইপে ব্যবহার করতেও শিখে গেছে। বিদেশে থাকা স্বজনরা এখন আর টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে নিজের গলার আওয়াজ পাঠায় না। গ্রামে কম শিক্ষিত অনেক তরুণ-তরুণী আজকাল নিয়মিত ফেইসবুক চালায়, তাদের ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে নিজের মতামত পোস্ট করে চমকে দেয়। গ্রামের মানুষ এখন ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বড় গ্রাহক। প্রায় এক কোটি গ্রামবাসী কৃষকের আছে নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের আওতায় চলে এসেছে গ্রামের অনেক মানুষ। বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুতের আওতায়। ৯৮ লাখ পরিবার সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। দেশে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে ১০০০-১২০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের সঙ্গে গ্রামে গেছে টেলিভিশন, কম্পিউটার, রেফ্রিজারেটরসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রীও। গ্রামের মানুষ এখন বলিউড তারকা শাহরুখ, সালমান, প্রিয়াংকা, দীপিকা, ঐশ্বরিয়াকে চেনে ভালো করেই। জনপ্রিয় বিদেশি হিন্দি বাংলা টিভি সিরিয়ালের প্রতিটি এপিসোড গ্রামের বউ-ঝিরাও দেখছে শহরের গৃহবধূ তরুণীদের মতো। গ্রামের নারীর সাজপোশাকেও গ্রাম্যতার ভাবটি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষও আজকাল আগের চেয়ে অনেক বেশি পোশাকসচেতন হয়ে উঠেছে। গ্রামের মেয়েদের সাজগোজেও শহুরে আমেজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেভাবে বিউটিপার্লারের ব্যবস্থা না থাকলেও গ্রামের বিয়েশাদি অনুষ্ঠানে আলাদাভাবে একটু যতœ নিয়ে সেজে অনেকেই যাচ্ছেন, যা খুব সহজেই চোখে পড়ছে। সব মিলিয়ে গ্রামীণ জীবনযাপনের চিত্রটাতে পরিবর্তনের প্রকাশ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।