পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বৃহৎ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দীর্ঘমেয়াদি কয়লা সরবরাহের চতুর্থ দফার দরপত্রও বাতিল করা হয়েছে। কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের বিভিন্ন ধাপে অনিয়ম ও ত্রুটির অভিযোগে দরপত্র বাতিলের সুপারিশ করে বিদ্যুৎ বিভাগের মূল্যায়ন কমিটি। একই সঙ্গে দ্রুত নতুন দরপত্র আহ্বানের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ গত ৭ আগস্ট আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেডকে (আরএনপিএল) পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছে, কয়লা আমদানির আহ্বান করা দরপত্রে নানা ধাপে অনিয়ম ও ত্রুটি ধরা পড়েছে। তাই দরপত্র বাতিল করে নতুনভাবে আহ্বান করতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে কয়লা কেনার টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন-বিশেষ করে ক্যালোরিফিক ভ্যালু (জিএআর), অ্যাশ ফিউশন টেম্পারেচার ও কয়লার সাইজ এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যেন দরপত্র প্রক্রিয়া অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক হয়। এছাড়া ভবিষ্যতে চুক্তির মেয়াদ ৫ বছরের বদলে ২ বছর করার সুপারিশ করেছে কমিটি।
এর আগে, কয়লার স্পেসিফিকেশন ও শর্ত শিথিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের প্রস্তাব এসেছিল। এবারও একই কারণ দেখিয়ে নতুন টেন্ডারের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে কয়লার মান আরও কমালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে বলছেন সংশিষ্টরা।
প্রথমবার ২০২২ সালের নভেম্বরে দরপত্র আহ্বান করা হলে সাতটি কোম্পানি শর্টলিস্ট হয়, যার মধ্যে ছিল সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড। কিন্তু শর্ত পরিবর্তনের কারণে সেটি বাতিল হয়।
দ্বিতীয়বার ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি টেন্ডার ডাকা হয়। এতে পাঁচটি কোম্পানি অংশ নেয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি দরপত্র খোলার সময় ইয়াংথাই এনার্জি কারিগরি দিক থেকে যোগ্য বিবেচিত হয়। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা বাতিল হয়ে যায়।
তৃতীয়বার গত বছরের ৬ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এতে দেশি-বিদেশি ২৫টি কোম্পানি অংশ নিলেও শর্ত পূরণ করে শুধু ইয়াংথাই এনার্জি চূড়ান্তভাবে কাগজপত্র জমা দেয়। অন্যরা টেন্ডার শর্ত কঠিন উল্লেখ করে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে শিথিল করার দাবি জানায়। পরে কিছু শর্ত শিথিল হলেও আর কোনো কোম্পানি অংশ নেয়নি। ফলে ইয়াংথাই একক দরদাতা হয়।
চতুর্থ দফায়ও ইয়াংথাই কারিগরি দিক থেকে যোগ্য হলেও আর্থিক অনিয়ম ও ত্রুটির অভিযোগ তুলে দরপত্র বাতিলের সুপারিশ করে মূল্যায়ন কমিটি। যদিও শর্ত অনুযায়ী একটি বিদেশি কোম্পানি নির্বাচিত হয়েছিল, তবে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর অভিযোগের কারণে প্রক্রিয়ায় অনিয়মের প্রশ্ন ওঠে।
বর্তমানে আরএনপিএল পরিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট প্রস্তুত থাকলেও কয়লা সরবরাহকারী চূড়ান্ত না হওয়ায় মাত্র ৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। পূর্ণ সক্ষমতায় যেতে না পারায় কেন্দ্রটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
কেন্দ্রটি নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার চীনের ঋণ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত এই ঋণচুক্তি অনুযায়ী ১৫ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। চার বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্প চালুর ছয় মাস পর থেকে ঋণ শোধ শুরু করার নিয়ম কার্যকর হয়েছে।
চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু করে। জুনে বাণিজ্যিকভাবে চালুর কথা থাকলেও টেন্ডার জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি। ফলে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর আগেই ঋণ শোধ শুরু হওয়ায় ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর বাইরে কেন্দ্রটি চালু না থাকলেও সরকারকে বড় অঙ্কের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে।
আরএনপিএল কর্তৃপক্ষ পাঁচ বছরের জন্য কয়লা সরবরাহকারী চূড়ান্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু দফায় দফায় টেন্ডারে নানা শর্ত ও জটিলতায় প্রক্রিয়া আটকে যাচ্ছে। এতে সরকারকে লোকসান গুনতে হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত জনগণের কাছ থেকে ভর্তুকি হিসেবে নেওয়া হচ্ছে।