জাতীয়

হাসিনার পতনের পরও মানবাধিকারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন পতনের এক বছর পরও বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার সুরক্ষায় গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে প্রচলিত গুম ও ভীতি প্রদর্শনের মতো অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমে এলেও, নতুন সরকার বিচারবহির্ভূত ও উদ্দেশ্যমূলক গ্রেপ্তারে জড়িয়ে পড়েছে এবং কাঙ্ক্ষিত সংস্কার এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, গত বছর যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তারা একটি মানবাধিকারসম্মত গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই আশা এখনও পূরণ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার যেন একটি অচল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সহিংস ধর্মীয় গোষ্ঠী ও প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতির মাঝে পড়ে গেছে।

২০২৪ সালে গঠিত ১১টি সংস্কার কমিশন, জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর, দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো নানা সুপারিশ পেশ করলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন এখনও হয়নি।

এদিকে দেশে বেড়েছে জনরোষের সহিংসতা, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং সংখ্যালঘু ও নারী অধিকারবিরোধী ধর্মীয় গোষ্ঠীর তৎপরতা।

গত ২৬ ও ২৭ জুলাই রংপুরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ১৪টি বাড়িঘর ভাঙচুর করে দাঙ্গাবাজরা। পার্বত্য চট্টগ্রামেও সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আন্দোলন দমাতে নিরাপত্তা বাহিনী ১ হাজার ৪০০ জনকে হত্যা করে। শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন, এবং ৮ আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।

তারপরও রাজনৈতিক হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে ছাত্র আন্দোলন থেকে গঠিত ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’র সমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হন। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগপন্থী সন্দেহে আট হাজারের বেশি নাম না-জানা ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয় এবং শত শত নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়।

২০২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৯২,৪৮৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যার অধিকাংশই হত্যার অভিযোগে। সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে ৬৮টি হত্যা বা হত্যাচেষ্টার মামলায় আটক দেখানো হয়েছে, যার ৩৬টির সময় তিনি দেশে ছিলেন না।

আগামী ৩ আগস্ট শুরু হতে যাচ্ছে প্রথম বিচার তাতে শেখ হাসিনাকেও অনুপস্থিত অবস্থায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে। তবে অধিকাংশ মামলায় অভিযোগ গঠন হয়নি, এমনকি কোনো প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়নি।

অপারেশন ডেভিল হান্ট” নামক অভিযানে ফেব্রুয়ারিতে ৮ হাজার ৬০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিচার খুব কমই হচ্ছে। গত বছর জুলাই-আগস্টের সহিংস অভিযানে পুলিশের অংশগ্রহণ থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

২০২৪ সালের আগস্টে গঠিত গুম তদন্ত কমিশন এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮০০-এর বেশি অভিযোগ পেয়েছে, এবং প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রমাণ নষ্ট করেছে ও তদন্তে সহায়তা করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত অনেকেই এখনও বাহিনীতে বহাল রয়েছে, কেউ কেউ পালিয়ে গেছে।

সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নারী অধিকারসহ ১১টি বিষয়ে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশও বাস্তবায়িত হয়নি। জাতিসংঘের ১৩২৫ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী নারী অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে নির্বিচার গ্রেপ্তার বন্ধ, র‍্যাব বাতিল, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত করা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দায়মুক্তি তুলে নেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। নারীর পূর্ণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

সংস্থাটি আরও বলেছে, বিদেশি সরকার ও জাতিসংঘের উচিত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ওপর লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার নীতিমালার আওতায় বিচার করা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশি অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মানবাধিকার রক্ষার শর্ত জুড়ে দেওয়া উচিত।

মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “ইউনূসের সরকার যে কঠিন বাস্তবতায় পড়েছে, তা কেউ অস্বীকার করছে না। তবে এ মুহূর্তেই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, যাতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে বাস্তব ও স্থায়ী পরিবর্তন আসে।”