ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, মিছিল, সড়ক অবরোধ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
হাদির মৃত্যুর খবর জানাজানি হওয়ার পর রাজধানীর শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা, কাওরান বাজার, ফার্মগেটসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে আসে। একাধিক স্থানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন এবং পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
রাতের বিভিন্ন সময় কয়েকটি এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। কোথাও কোথাও ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করে এবং জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চত্বর ও রাজু ভাস্কর্যের সামনে কয়েকশ শিক্ষার্থী জড়ো হন। ডাকসুর নেতৃত্বে বিশাল একটি মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শাহবাগে এসে মূল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
এই বিক্ষোভে জুলাই মঞ্চের কর্মী-সমর্থক ছাড়াও বুয়েটের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলন চলাকালে শাহবাগে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং সাবেক দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমসহ জাতীয় ছাত্রশক্তির নেতারা সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভে অংশ নেন।
বিক্ষোভের এক পর্যায়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ একটি দল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবনে হামলা চালায়। এ সময় ভবন দুটিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।
এ সময় তারা প্রথম আলো ও ভারতবিরোধী নানা স্লোগান দেন। এক পর্যায়ে কিছু লোকজন অফিসের ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর করেন। এছাড়া কার্যালয়ের সামনে অগ্নিসংযোগও করেন।
একই সময়ে ডেইলি স্টার ভবনেও হামলার ঘটনা ঘটে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া লাইভ ভিডিওতে দেখা যায়, লাঠিসোটা নিয়ে একটি দম্পতি বা দল অফিসে হামলা চালাচ্ছে এবং ভাঙচুর করছে। এ ঘটনায় ভেতরে বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী আটকা পড়েন।
ডেইলি স্টারের স্টাফ রিপোর্টার আহমেদ দীপ্ত জানান, ছাদের ওপরে প্রায় ২০ জনের মতো অবস্থান নিয়েছিল। হামলাকারীরা আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় ধোঁয়ার কারণে চলাফেরা করা যাচ্ছিল না। পরে সাংবাদিকরা ছাদে অবস্থান নিয়ে নিরাপত্তা বজায় রাখার চেষ্টা করেন।
পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হামলাকারীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে।
এদিকে হাদির গ্রামের বাড়িতে মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছালে সেখানে শোকের ছায়া নেমে আসে এবং স্থানীয় লোকজন জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। শাহবাগে আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, হাদি হত্যার সুষ্ঠু বিচার এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না।
রাজধানীর বাইরে কয়েকটি জেলা শহরেও হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয়ভাবে কোথাও কোথাও সড়ক অবরোধ, মিছিল ও দোকানপাট বন্ধ থাকার ঘটনাও ঘটে। এতে সাধারণ মানুষের চলাচল ব্যাহত হয় এবং জনজীবনে ভোগান্তি দেখা দেয়।
রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভকারীরা। একই সঙ্গে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। রাজশাহীতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় নগর আওয়ামী লীগ অফিস। সিলেট ও বরিশালে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়, আর নেত্রকোনায় সড়কে আগুন জ্বালিয়ে হত্যার বিচার দাবি করেন আন্দোলনকারীরা।
শরিফ ওসমান হাদি সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত একটি নাম ছিলেন। তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে ইতোমধ্যে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিদেশে মারা যান। তার মরদেহ দেশে আনার প্রস্তুতি চলছে এবং জানাজা ও দাফনের সময়সূচি পরে জানানো হবে।
এদিকে হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যাতে আরও কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। রাজধানী ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় টহল জোরদার করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও এই মৃত্যুকে ঘিরে শোকের আবহ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে শোক প্রকাশ করা হলেও একই সঙ্গে সহিংসতা ও ভাঙচুর থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে।