জাতীয়

অবিচল-আপোষহীন এক রাজনৈতিক পথিকৃতের লাল-সবুজে মোড়ানো বিদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

লাল-সবুজে মোড়ানো একটি গাড়ি যখন ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন সেটি কেবল একজন নেত্রীর মরদেহ বহন করছিল না, তা বহন করছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক দীর্ঘ, বিতর্কময়, কিন্তু অবিসংবাদিত অধ্যায়কে। এই লাল সবুজের পতাকা, এই বাংলার মানচিত্রে মিশে আছে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম, পাওয়া-না পাওয়ার শত গল্প। একটি বাংলাদেশের সেবায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুকালীন সময়েও যিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধু। তিনি হয়ে উঠলেন আন্দোলন- সংগ্রাম, আপোষহীনতা ও নারী নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল প্রতিফলন। 

জাতীয় পতাকায় আবৃত সেই গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের শিক্ত চোখে, মুখে চাপা দীর্ঘশ্বাস; সামনে যেনো সমৃদ্ধ এক ইতিহাসের ভার।

বেগম খালেদা জিয়ার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় রাজধানীর রাজপথে তৈরি হয়েছিল এক অভূতপূর্ব আবেগঘন দৃশ্যপট। স্তব্ধ সাধারণ মানুষ, শোকার্ত দলীয় নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, সবাই নীরব শ্রদ্ধা‍য়। কেউ হাত তুলে বিদায় জানাচ্ছিলেন, কেউ বা কোরআনের আয়াত পাঠ করছিলেন।

লাল-সবুজে মোড়ানো গাড়িটি যেনো হয়ে উঠেছিল দেশের রাজনীতি ও স্মৃতির এক সম্মিলনের প্রতীক।

চির বিদায়ের এই সমাগমে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলও উপস্থিত ছিলেন, শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রদূত ও বেশ কিছু দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একত্রিত হয়ে খালেদা জিয়ার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানালেন।

উপস্থিতদের মতে, এটি কেবল রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব ও পরিচিতির প্রতীক। পাশাপাশি, শেষ সময়ে পাওয়া এই সম্মান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও খালেদা জিয়াকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের এক ব্যতিক্রমী চরিত্র হিসেবে তুলে ধরেছে। একাধিক বৈদেশিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং বিরোধী অবস্থায়ও ছিলেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, এবং তার মৃত্যু আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সংবেদন সৃষ্টি করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার শেষ যাত্রা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের রাজনীতির খুব কম নেতা বিদায়ের সময় এমন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান। তার রাজনৈতিক জীবন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সংসদীয় রাজনীতি, ক্ষমতায় থাকা ও বিরোধী অনড় অবস্থান। সব মিলিয়ে তাকে বাংলাদেশের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে।

গাড়িটি যখন তার শেষ গন্তব্যে পৌঁছায়, তখন চারপাশের মানুষের চোখে শূন্যতা, মুখে নীরব শ্রদ্ধা। লাল-সবুজে মোড়ানো সেই গাড়ি শুধু একজন নেত্রীর বিদায় বহন করেনি; তা বহন করেছে এক সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ধারার সমাপ্তি এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের ইতি।

রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সাধারণ মানুষের আবেগ, সবকিছু মিলিয়ে খালেদা জিয়ার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়ে উঠল এক বিরল রাষ্ট্রীয় মুহূর্ত, যা দীর্ঘদিন ধরে মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।