প্রতিবন্ধিতা- শব্দটা উচ্চারণ করলেই অনেকে এখনো করুণা দেখাতে প্রস্তুত হয়ে যায়। যেন এরা সমাজের ‘বোনাস’ মানুষ। অথচ বাস্তবতাটা তার উল্টো—বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটির মতো মানুষ প্রতিদিন অদৃশ্য লড়াই করে বেঁচে আছেন, শুধু কারণ সমাজ তাদেরকে সমান মানুষ হিসেবে দেখার জন্য এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।
এই লেখার উদ্দেশ্য করুণা দেখানো নয়—বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো: সমাজের কাঠামোই কেমন করে সাধারণ, প্রতিভাবান, সক্ষম মানুষদের প্রতিনিয়ত অক্ষম করে তোলে।
এ বিষয়ে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ও গবেষক ড.মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন-
এ বছরের প্রতিপাদ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, সম্মান ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা শুধু সামাজিক দায়িত্ব নয়, এটি মানবিক অঙ্গীকার। সমতা, সংহতি ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে প্রত্যেকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রাখতে পারে। আসুন, বৈষম্যহীন ও সবার জন্য উপযোগী বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাই।
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস-২০২৫ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কেবল নীতি কিংবা সহানুভূতির বিষয় নয়—এটি মানবাধিকার, সক্ষমতা ও সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তরের প্রক্রিয়া। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি এবং নিরাপদ চলাচলের অধিকার নিশ্চিত করা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (SDGs) অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য।
একজন বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শুধু সেবা-গ্রাহী নয়, বরং নীতি-প্রণয়ন, গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নেতৃত্বের কেন্দ্রে আনতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ডেটা সংগ্রহ, বাস্তবসম্মত আইন প্রয়োগ, প্রতিবন্ধীতার বৈচিত্র্য অনুযায়ী সেবা-পরিকল্পনা, এবং পরিবার-কমিউনিটি ভিত্তিক সমর্থনব্যবস্থা শক্তিশালী করা।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এমন এক সমাজ গড়ে তুলি যেখানে কারও সীমাবদ্ধতা নয়, বরং প্রত্যেকের সক্ষমতা উন্নয়নই হবে অগ্রগতির মূল ভিত্তি।
প্রতিবন্ধীর প্রতিবন্ধকতাঃ
অদৃশ্য সংগ্রাম- যা সমাজ দেখে না, দেখতে চায়ও নাঃ
সকালে স্কুল খোলা। কিন্তু দেশের অসংখ্য শিশু শুধু বই নয়, বহন করে আরেক বোঝা- অন্যের চোখের তাকানো।
হুইলচেয়ার নিয়ে স্কুলে ঢোকার র্যাম্প নেই,
শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছাত্রের জন্য নেই ইশারা-ভাষার শিক্ষক,
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর জন্য ব্রেইল বই আসে বছরে একবার—তাও অসম্পূর্ণ।
এই শিশুরা জানে, তারা অক্ষম নয়; সমাজের অবকাঠামোই অক্ষম।
তারা জানে “আমার সমস্যাটা আমি নই; সমস্যা হলো, সমাজ আমাকে নিয়েই সমস্যায় পড়ে।”
অধিকার আছে- কিন্তু নাগালের বাইরেঃ
সংবিধান থেকে আন্তর্জাতিক কনভেনশন, সব নথিতেই প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার স্পষ্ট লেখা।
কিন্তু বাস্তবতা?
জেলা হাসপাতালে র্যাম্প নেই
সরকারি নিয়োগে কোটা থাকলেও বাস্তবে প্রবেশগম্যতা না থাকায় পরীক্ষায় অংশ নেওয়াই কঠিন
পরিবহন খাতে ‘প্রবেশ-অযোগ্যতার’ নির্মমতা
কর্মক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিগত বৈষম্য
একজন সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তরুণীর কথা মাথায় আসে—
পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র পড়িয়ে দেওয়ার অনুমতি ছিল, কিন্তু দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বলেছিলেন,
“সময় তো নেই।”
আইন আছে, অধিকারও আছে, কিন্তু যতক্ষণ না সিস্টেম বদলাবে, কাগজের অধিকার কাগজেই থেকে যাবে।
সম্ভাবনার গল্প- সুযোগ পেলে বদলে যায় সবঃ
করুণার নয়, সুযোগের গল্প সবচেয়ে শক্তিশালী।
যখন একটা ডিজিটাল স্কিল ট্রেনিং সেন্টার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তরুণদের স্ক্রিন-রিডার ব্যবহার শিখিয়েছে,তাদের অনেকে আজ ফ্রিল্যান্সার, কেউ শিক্ষক, কেউ আবার কমিউনিটি লিডার।
যখন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী এক নারীকে কর্মক্ষেত্রে কেবল প্রবেশযোগ্য টয়লেট আর লিফট দেওয়া হয়েছিল, তিনি নিজেই লিখে ফেললেন প্রকল্প প্রস্তাব:
“Barrier-free is not charity, it’s civil rights.”
অর্থাৎ, সুযোগ দিলে সক্ষমতা নিজেই প্রমাণ হয়ে যায়।
সংক্ষেপে: সমাজ বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে।
প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবন কোনো করুণার গল্প নয়, এটা সমান অধিকারের গল্প।
এটা সেই গল্প- যেখানে অদৃশ্য সংগ্রাম আর অদৃশ্য প্রতিভা লুকিয়ে আছে, শুধু সামান্য প্রবেশগম্যতা আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের অপেক্ষায়।
শেষ কথা-
মানুষ প্রতিবন্ধী নয়, সমাজই প্রতিবন্ধী, যদি সে সমান সুযোগ দিতে না পারে।
এই মানুষগুলো কোনো “বিশেষ” মানুষ নয়; এরা আমাদের মতোই, আমাদের সাথে, সমাজ তৈরির প্রথম সারির নাগরিক।