মতামত

পুলিশের সাথে বাস্তব অভিজ্ঞতা

'বৃষ্টিভেজা রাস্তায় পুলিশের একাকী সংগ্রাম'

নিজস্ব প্রতিবেদক

কোভিডের আতঙ্কে যখন মানুষ দূরে সরে যাচ্ছিল, তখন এক পুলিশ অফিসার একা হাতে এগিয়ে গেলেন একজন মৃত মানুষের দায়িত্ব নিতে। সেই দৃশ্য একজন নির্মাতার চোখে পুলিশকে নতুনভাবে দেখার দরজ খুলে দিয়েছিল।

পুলিশের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি

আমাদের সমাজে পুলিশ মানেই ভয় অভিযোগ আর নেতিবাচকতা। ছোটবেলা থেকেই আমরা। শিখি- এটা না করলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। বড় হতে হতে সেই ভয়ই ঘৃণায় রূপ নেয়। টেলিভিশন সংবাদপত্র বা সামাজিক মাধ্যমে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগই বেশি প্রচারিত হয়-মুষ, হয়রানি, নিরীহ মানুষকে ফাঁসানো ইত্যাদি।

কিন্তু সত্যিই কি পুরো চিত্রটা এমন। নাকি বাস্তবতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্যরকম কিছু মানবিক গল্প?

কোডিড-১৯ সময়ের একটি দিন

২০২০ সালের সেই ভয়াবহ সময়ে আমি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান তৈরি করছিলাম। ডাক্তার, নার্স, খেটে খাওয়া মানুষ- তাদের সংগ্রাম তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম।

একদিন মালিবাগে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তার সাক্ষাৎকার নিতে যাচিছলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি হাচিচ্ছল। হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটি রিকশায় একজন মানুষ অস্বাভাবিকভাবে ঝুলে আছে। মাখাটা পেছনে হেলে পড়েছে। নিশ্চিত হতে পারলাম না- বেঁচে আছেন নাকি মৃত।

কিছুটা এগোতেই আরেকটি দৃশ্য চোখে পড়লো রাস্তার পাশে পড়ে আছে একটি লাশ, পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশের টহল গাড়ি। মনে হলো, হয়তো করোনায় মারা গেছেন কেউ।

সাক্ষাৎকার শেষে ফেরার পথে

ডাক্তারের সাক্ষাৎকার শেষ করে ফেরার পথে আবার সেই রাস্তার কাছাকাছি আসি। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম-রাস্তার পাশে লাশটি নেই পুলিশের গাড়িও নেই। কিন্তু রিকশার ভেতরে ঝুলে থাকা সেই মানুষটি তখনও আছেন-এবার স্পর্টি বোঝা গেল, তিনি আর বেঁচে নেই।

ঠিক তখনই ধীরে ধীরে একটি পুলিশ মোটরসাইকেল এসে থামলো। অফিসারের গায়ে সাদা রেইনকোট। প্রথমে মনে হলো তিনি হয়তো এডিয়ে যাবেন। কিন্তু কিছু দূর গিয়ে লুকিং গ্লাসে ফিরে তাকালেন। তারপর মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে আবার রিকশার কাছে এলেন।

দায়িত্ববোধ বনাম ভয়

পুলিশ অফিসার একা হাতে চেষ্টা শুরু করলেন লাশটি সরানোর। চারপাশে মানুষ থাকলেও কেউ এসিয়ে এল না। আমি গাড়ির ভেতরে বসে দ্বিধায় ভুগছিলাম যাবো কি যাবো না? ভয় হচ্ছিল, করোনা ধরতে পারে, আমার পরিবার আছে, তাদের কথা মাথায় ঘুরছিল।

কিন্তু অফিসার বিন্দুমাত্র দ্বিয়া করলেন না। তাঁরও হয়তো পরিবার আছে, ছোট সন্তান আছে। তবুও তিনি দায়িত্ববোধ থেকেই এগিয়ে গেলেন।

পুলিশের মানবিক মুখ

আমরা সাধারণত পুলিশের ভুলটাই দেখি। যখন কোনো নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হয় কিংবা কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন সেটাই শিরোনাম হয়। অথচ মানবিক কাজগুলো খুব কমই প্রচারিত হয়।

সেই দিন আমি দেখলাম ভয়, ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তার মাঝেও একজন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব থেকে সরে যাননি। তাঁর মানবিক মুখটাই আমাকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল।

আমার উপলব্ধি

সেই দৃশ্যের পর থেকে আর কোনো কাজে তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল আমাদের চোখে যে পুলিশ সবসময় 'খারাপ, তাদের মানবিক দিকটা কেন দেখাই না? হয়তো সেদিন থেকেই পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্টারি বানানোর চিন্তা আমার মাথায় আসে।

শেষ কথা

আমরা প্রায়ই পুলিশের সমালোচনা করি। তাদের ভুল আছে ব্যর্থতা আছে-যেমন আমাদের সমাজের অন্য সবার মধ্যেও আছে। কিন্তু সবকিছুর আড়ালে আছে কিছু নিরলস দায়িত্ববোধ, কিছু মানবিকতা, যা আমরা দেখতে চাই না।

সেই বৃষ্টিভেজা দিনে আমি যে দৃশ্য দেখেছিলাম, তা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল-পুলিশও মানুষ। পার্থক্য শুধু একটাই ভয় ক্লান্তি শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও তারা দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারেন না।

লেখা- মোঃ খাইরুল ইসলাম তুফান।