নারী অধিকার নিয়ে আমরা কথা বলি অনেক। দিবস পালন করি, ব্যানার টাঙাই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ লিখি। কিন্তু বাস্তবে প্রশ্নটা থেকেই যায়, এই অধিকারগুলো কি নারীর জীবনে সত্যিই পৌঁছাচ্ছে, নাকি কাগজেই সীমাবদ্ধ?
বাংলাদেশে নারী অধিকার নিয়ে আইনের অভাব নেই। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, উত্তরাধিকার, সহিংসতা প্রতিরোধ- সব ক্ষেত্রেই আইন আছে। কিন্তু অধিকার আর আইনের মধ্যে যে দূরত্ব, সেটাই আজ সবচেয়ে বড় সংকট। কারণ অধিকার কেবল ঘোষণায় বাস্তব হয় না, বাস্তব হয় প্রয়োগে।
আজও একজন নারী ঘর থেকে বেরোলে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়। কর্মক্ষেত্রে গেলে যোগ্যতার চেয়ে চরিত্র নিয়ে বেশি প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। সহিংসতার শিকার হলে বিচার পাওয়ার আগে তাকে প্রমাণ করতে হয়, সে সত্যিই ভুক্তভোগী। এই বাস্তবতায় নারী অধিকার অনেক সময় আইনের ভাষায় শক্ত, কিন্তু জীবনের ভাষায় দুর্বল।
সমস্যাটা শুধু অপরাধীর নয়, মানসিকতারও। আমরা এখনো নারীকে ব্যক্তি হিসেবে নয়, সম্পর্ক দিয়ে চিহ্নিত করি, কারো মেয়ে, কারো স্ত্রী, কারো বোন। ফলে তার নিজের অধিকার গৌণ হয়ে যায়। নারী যখন সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটা ‘অবাধ্যতা’; পুরুষ নিলে সেটা ‘নেতৃত্ব’। এই দ্বৈত মানদণ্ডই নারী অধিকার বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় বাধা।
গ্রাম হোক বা শহর, নারীর ওপর সহিংসতার ধরন বদলায়, কিন্তু মূল সংকট একই থাকে। কোথাও বাল্যবিয়ে, কোথাও যৌন হয়রানি, কোথাও পারিবারিক সহিংসতা। অভিযোগ করলে অনেক সময় নারীই একঘরে হয়, মামলা করতে গেলে সামাজিক চাপ শুরু হয়। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা নারীর ন্যায়ের পথ আরও কঠিন করে তোলে।
শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু ক্ষমতার জায়গায় নারীর উপস্থিতি এখনো সীমিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে নারীর কণ্ঠ যতদিন না শক্ত হবে, ততদিন নারী অধিকার পূর্ণতা পাবে না। অংশগ্রহণ আর ক্ষমতায়নের পার্থক্যটা এখানেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- নারী অধিকার মানেই পুরুষের বিপরীতে দাঁড়ানো নয়। এটি মানবাধিকারেরই অংশ। কিন্তু আমাদের সমাজে বিষয়টি প্রায়ই ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়। ফলে নারী অধিকার নিয়ে কথা বললেই একধরনের প্রতিরোধ তৈরি হয়, যেন এটি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর দাবি।
এখানে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আইন প্রয়োগ যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন সামাজিক সংস্কার। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্ব, সব জায়গা থেকেই নারীর প্রতি সম্মান ও সমতার বার্তা আসতে হবে। নইলে আইন থাকবে, কিন্তু অধিকার পৌঁছাবে না।
সবশেষে প্রশ্নটা খুব সোজা, আমরা কি নারী অধিকারকে কেবল আলোচনার বিষয় হিসেবে রাখবো, নাকি জীবনের বাস্তবতায় রূপ দেবো? একজন নারী নিরাপদ না হলে, স্বাধীন না হলে, সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সমাজের অর্ধেক শক্তি অচল থেকে যায়।
নারী অধিকার কোনো বিশেষ দাবি নয়, এটি একটি ন্যায্য বাস্তবতা। এই বাস্তবতা যতদিন না নারী নিজে অনুভব করতে পারবে, ততদিন আমাদের সব আলোচনা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।