মতামত

‘মৈত্রী’র মুখোশে নিয়ন্ত্রণের কূটনীতি: ভারতের কার্গো রুট বন্ধের পাঠ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই “ঐতিহাসিক মৈত্রীর” আলোকে মূল্যায়িত হয়ে আসছে। কিন্তু এই সম্পর্ক যখন বারবার একতরফা নির্ভরতায় পরিণত হয় এবং সেই নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে ভারত যখন নিজের রাজনৈতিক বা কৌশলগত উদ্দেশ্য পূরণে চাপ প্রয়োগ করে—তখন প্রশ্ন উঠে, আমরা আদৌ কূটনৈতিক স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারছি কি?

সম্প্রতি ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের মধ্য দিয়ে চলাচলকারী করিমগঞ্জ-ডাউকি-তামাবিল ট্রান্সশিপমেন্ট রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই রুট দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মালামাল সরবরাহ করা হতো বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে। চুক্তি অনুযায়ী, এটি ভারতের জন্য ছিল ‘স্বল্প খরচে আন্তর্জাতিক রুট’। আর আমাদের জন্য এটি ছিল "আঞ্চলিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র" হওয়ার একটি সম্ভাবনাময় সুযোগ।

কিন্তু হঠাৎ রুট বন্ধ করে দেওয়া প্রমাণ করে, এই সম্পর্ক কেবল ভারত-প্রীতির রূপকথায় আবদ্ধ নয়, বরং এতে রয়েছে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের স্পষ্ট কৌশল। ভারতের যুক্তি, "বিলম্ব ও প্রশাসনিক জটিলতা"। অথচ চুক্তির সময় এসব জানারই কথা ছিল। তারা ঠিক যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপাকে- বিদ্যুৎ সংকট, রপ্তানি কমছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পড়ে যাচ্ছে, তখনই এই চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন তৈরী হয়-

  • ভারত কি কেবল চুক্তির সুবিধা নিতে চায়, কিন্তু সংকটকালে দায় নিতে চায় না?

  • কেন আমাদের অবকাঠামো এমনভাবে সাজানো হয়নি যে এক রুট বন্ধ হলে বিকল্পে চলতে পারি?

  • আমাদের নীতিনির্ধারকরা এই চুক্তিগুলো করতে গিয়ে কতটা ‘গণতান্ত্রিক স্বার্থ’ রক্ষা করেছেন?

খুব সাদামাটা ভাবে ভাবলেই আমরা কিছু সমস্যা নিরুপণ করতে পারি যেমনঃ

১. কার্গো ট্রান্সশিপমেন্টের শর্ত:
চুক্তি অনুযায়ী, ভারত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের জন্য মাত্র ২০ টাকার মতো ন্যূনতম ফি দেয়। এই ব্যবস্থায় বাংলাদেশ আয়ের দিক দিয়ে খুব সামান্য উপকৃত হয়।

২. বিকল্প রুটের অভাব:
আমরা আজও এমন আন্তঃজেলা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি যা জরুরি প্রয়োজনে বিকল্প হিসেবে কাজ করে। অথচ “ব্লু ইকোনমি”, “গেটওয়ে কানেক্টিভিটি” এসব শব্দে নীতিনির্ধারকরা সরব।

৩. আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি:
ভারত এর মাধ্যমে আবারও দেখিয়ে দিল যে তাদের ‘প্রতিশ্রুতি’ কূটনৈতিক সুবিধা না থাকলে টেকসই নয়। এটা এমন এক নিপুণ রাজনৈতিক কৌশল, যাকে বলা যায় ‘কন্ট্রোল থ্রু কনেক্টিভিটি’।

ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র একথা চন্দ্র-সূর্যের মতো সত্য। তবে প্রতিবেশীদের সাথে যথাযথ ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা দু-পক্ষের জন্যই লাভজনক। আসে ভিত্তিতে সমস্যা নিরসনে এই বিষয়গুলোতে নজর দিতে পারিঃ  

  • স্বাধীন বন্দর নীতি: যে কোনো রাষ্ট্র যদি আমাদের বন্দর ব্যবহার করে, সেখানে স্বচ্ছ অর্থনৈতিক লাভ নিশ্চিত করতে হবে। স্বার্থরক্ষা কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছায় না রেখে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে হতে হবে।

  • কৌশলগত বিকল্প প্রস্তুতি: রেল, নদীপথ ও স্থলবন্দর ব্যবস্থার ভিন্ন ভিন্ন বিকল্প রুট উন্নয়নে বিনিয়োগ জরুরি। যাতে একটা পথ বন্ধ হলেও দেশ অচল হয়ে না পড়ে।

  • প্রতিদান ভিত্তিক কূটনীতি: আমাদের কূটনীতিকে আবেগ নয়, লাভ-ক্ষতির কঠোর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পরিচালিত করতে হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে ভারত সহায়ক ছিল, এ সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হলো- সার্বভৌমত্ব একবার অর্জনের পর তা রক্ষা করা আরও কঠিন কাজ। ট্রান্সশিপমেন্ট রুটের হঠাৎ বন্ধ হওয়া আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ‘মৈত্রীর আবরণে মোড়ানো রাজনীতি’ কতটা দুর্বল করে ফেলেছে আমাদের কৌশলগত অবস্থানকে।

এখন সময় এসেছে- আমরা কি একতরফা সুবিধা দিয়ে যাব, না কি ন্যায্যতা দাবি করতে শিখব?