মতামত

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য: আধিপত্য বনাম বিকল্প কাঠামো

নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ শতকের তৃতীয় দশকটি দাঁড়িয়ে আছে এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের মুখোমুখি। বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য, চীনের আগ্রাসী উত্থান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৌশলগত নড়াচড়া এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের (Global South) জেগে ওঠা—সবমিলিয়ে এক নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। ঠিক এমন এক সন্ধিক্ষণে, মার্কিন প্রশাসন যখন ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে একটি সর্বজনীন ১০% শুল্কনীতি চালু করে, তখন তা কেবল আমদানি নিয়ন্ত্রণ নয়—বরং একটি নতুন অর্থনৈতিক যুগের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্রতা: আধিপত্য নাকি দুর্বলতার প্রকাশ?

যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রেখেছে চারটি মূল উপাদানের মাধ্যমে—

  1. ডলার ভিত্তিক বৈশ্বিক লেনদেন,

  2. প্রযুক্তিনির্ভর বাজার নিয়ন্ত্রণ,

  3. বিনিয়োগ ও ঋণনীতি,

  4. ভূরাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা

তবে আজকের বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে: এই আধিপত্য কি অব্যাহত থাকবে, নাকি এটি এক ধরণের অবসান-প্রক্রিয়ার সূচনা?

বিশ্বব্যাপী মার্কিন শুল্কনীতি নিয়ে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেসব দেশ আমেরিকার সঙ্গে ঘাটতির মধ্যে আছে, তাদের ওপর ১১%-৫০% শুল্ক আরোপ করা—আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে এক প্রকার একতরফা সিদ্ধান্ত।

নতুন শুল্কনীতির বাস্তব প্রভাব

‍ চীন ও অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়া:

চীন ইতোমধ্যে প্রতিশোধমূলক শুল্কের হুমকি দিয়েছে, যা সরাসরি এক নতুন বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। একইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্যোগ গ্রহণ করছে।

 বাজারে অস্থিরতা:

এসঅ্যান্ডপি ৫০০-র ১০% পতন, বৈদেশিক বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা এবং মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা বিশ্ব অর্থনীতিকে একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে গেছে।

 সাধারণ জনগণের প্রভাব:

দামের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সংকট—বিশ্বজুড়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণিকে প্রতিদিন চাপের মুখে ফেলছে।

শেয়ার বাজার ও ট্রেড মার্কেট:

ট্রেড মার্কেট আজকের দিনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির পরিবর্তে অনেকটাই জুয়া-নির্ভর। গুজব, ইনসাইডার ট্রেডিং, বড় বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্ব ও রাজনৈতিক ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে স্টকের দাম ওঠানামা করে।

একটি পণ্যের প্রকৃত মূল্য যদি বিনিয়োগকারীর ‘আস্থা’ বা ‘ভয়’-এর উপর নির্ভর করে, তবে তা আর অর্থনীতির অংশ থাকে না—তা হয়ে ওঠে জুয়াড়িদের খেলার ময়দান।

ডলার-নির্ভরতাঃ শৃঙ্খল না স্বাধীনতা?

বিশ্বের অধিকাংশ বাণিজ্য এখনো ডলারে হয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যখনই নিজের অর্থনীতিতে ঝুঁকি অনুভব করে, তখন ডলার-ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে গোটা বিশ্বকে মূল্য দিতে হয়।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিকল্প চিন্তা শুরু হয়েছে—

  1. ব্রিকস দেশগুলো সুইফট (SWIFT) এর বিকল্প ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে কাজ করছে,

  2. চীন ও রাশিয়া নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়িয়েছে,

  3. BIMSTEC, African Union ইত্যাদি জোটগুলো আঞ্চলিক মুদ্রাবিনিময় চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে।

উন্নয়নশীল দেশের জন্য করণীয়

১. উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ:
নিজস্ব প্রযুক্তি, কৃষি, শিল্প খাতকে উন্নত করে বৈদেশিক পণ্যের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে।

২. ডলার থেকে নিরপেক্ষ বাণিজ্য রূট:
ন্যাশনাল কারেন্সি বা মাল্টি-কারেন্সি প্ল্যাটফর্মে লেনদেনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

৩. স্থানীয় বাজার ও কৃষিকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি পুনর্গঠন:
ফুড সিকিউরিটি, কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

৪. বহুপক্ষীয় ও ন্যায্য বাণিজ্যনীতি:
বাণিজ্য চুক্তিতে মানবিকতা ও ন্যায্যতার নীতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ভবিষ্যতের পথে বিকল্প কাঠামোর সন্ধান

বিশ্ব অর্থনীতি এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন একক অর্থনৈতিক কাঠামো ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ মুহূর্তে প্রয়োজন—

  • বিকেন্দ্রীকৃত, ন্যায্য, স্বনির্ভর অর্থনীতি গঠনের চিন্তা,

  • নতুন প্রযুক্তি, টেকসই উৎপাদন ও আঞ্চলিক সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক বাণিজ্য কাঠামো পুনর্গঠন।

এই পুনর্গঠন হবে না রাতারাতি, কিন্তু আলোচনা শুরু না হলে পরিবর্তন কখনোই সম্ভব নয়।