রাজনীতি

খালেদা জিয়া : বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ‘আপসহীন নেত্রী’

নিজস্ব প্রতিবেদক

 বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়ার মতো খুব কম নেতা ও নেত্রীই এত শ্রদ্ধা, বিতর্ক ও ধৈর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এই উপাধিটি তিনি পেয়েছেন  স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর ধারাবাহিক দৃঢ় অবস্থান, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় লড়াইয়ে কারণে।

গণতন্ত্র, মর্যাদা ও জবাবদিহিতে বিশ্বাসী অনেক বাঙালির কাছে তিনি শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছেন। চার দশকের বেশি সময়ের রাজনৈতিক যাত্রায় তিনি জয় দেখেছেন, হার মেনেছেন, কারাবরণ করেছেন, আবার ঘুরেও দাঁড়িয়েছেন। আর এভাবেই গণতন্ত্র, মর্যাদা ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী বহু মানুষের কাছে দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি।

খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসা ছিল আকস্মিক ও বেদনাবহ। তিনি জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ব্যক্তিগত ট্রাজেডি এবং নেতৃত্বের হঠাৎ শূন্যতার কারণে।  

খালেদা জিয়ার জীবনীকার মাফুজ উল্লাহ জানান, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় তিনি রাজনীতির প্রতি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু ১৯৮১ সালে তাঁর স্বামীর হত্যাকাণ্ড সব কিছু বদলে দেয়। ১৯৮৪ সালে বেগম জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মুখ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

আশির দশকের মাঝামাঝি যখন এরশাদ সামরিক শাসনকে ‘নির্বাচনের’ মাধ্যমে বৈধ করার চেষ্টা করেন, তখন বিরোধী দলগুলো অংশ নেবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে বেগম জিয়া কালজয়ী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি স্পষ্ট ঘোষণা দেন, নির্বাচন বর্জনের।

১৯৮৬ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নেননি। সামরিক শাসনের প্রভাবে নির্বাচনী পরিবেশে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলে ৫ দফা দাবি উপস্থাপন করেন তিনি। 

বিশ্লেষকরা এটিকে সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন, যা অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের থেকেও তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল।

একই বছর ১৩ অক্টোবর তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। কিন্তু মুক্তির পরও তিনি পিছু হটেননি। বরং সভা-সমাবেশ, ধর্মঘট, অনশন ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই শুরু করেন।  

১৯৮৮ সালে মার্চে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। সব প্রধান বিরোধী দল তখন সেই একতরফা ভোট বর্জন করে। 

বেগম জিয়া তখনও ছিলেন পুরোপুরি আপসহীন। শাসক দল নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করলেও তিনি তা প্রত্যাখান করেছিলেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, এই নির্বাচন অবৈধ ছিল।

অবশেষে তাঁর সেই দীর্ঘ লড়াই ফলপ্রসূ হয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এই পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি ছিল বেগম খালেদা জিয়ার অদম্য নেতৃত্ব ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব।

১৯৯১ সালের নির্বাচন ছিল এরশাদ পতনের পর প্রথম ভোট। বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৪০টিতে জয় পায়। ওই সময় বেগম জিয়া নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা পাঁচটি আসনেই জয়ী হন। এরপর দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

সরকারে গিয়েই তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও নীতিগত সংস্কার কার্যক্রম চালান। সেগুলো হল- ১২তম সংশোধনী পাস করে দেশে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনেন। ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করেন।

তাঁর শাসনামলে শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, অবকাঠামো ও জনকল্যাণ খাতে বিস্তৃত উদ্যোগ নেওয়া হয়।

প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বেসরকারি ও দূরশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহ দেওয়ার মত উদ্যোগ সেসময় ব্যাপক আলোচিত হয়।

পরিবেশ রক্ষায়ও তিনি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ। এছাড়া কর্মসংস্থান, কৃষি সংস্কার ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিও জোরদার করা হয়।

বেগম জিয়ার নেতৃত্ব ছিল নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধে পরিপূর্ণ। অনেকের মতে, তিনি একবার সিদ্ধান্ত নিলে সেখান থেকে পিছু হটতেন না। মিথ্যা মামলা, কারাবাস কিংবা নির্যাতন কোনো কিছুই তাঁর অবস্থান টলাতে পারেনি। 

তাঁর মূলমন্ত্র ছিল, ‘বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হলে, আমি সমৃদ্ধ হব’ এবং ‘এই দেশই আমার একমাত্র ঘর।’ 

দৃঢ়তা যেমন খালেদা জিয়াকে জনপ্রিয় করেছিল, তেমনি ডেকে এনেছিল দুর্ভোগও। বারবার গ্রেফতার, মামলা, গৃহবন্দিত্ব সবই তাঁকে মেনে নিতে হয়েছে বিভিন্ন সরকারের আমলে।

২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের সময়ও তিনি গ্রেফতার হন। সেসময় তাকে বিদেশে পাঠানোরও চেষ্টা করা হয়েছিল। পরে তাঁকে কারাগারে আটক রাখা হয়।

একসময় ঢাকা সেনানিবাসের মইনুল রোডে অবস্থিত স্বামী ও সন্তানদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিও সরকার দখলে নেয়। 

ওয়ান ইলেভেন সরকার ও পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তিনি দণ্ডিত হন। 

তবে দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকরা এই মামলাগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেন।

শারীরিক অসুস্থতা, দুর্বলতা ও হাসপাতালে যাতায়াতের মধ্যেও তিনি নিজের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে একচুল পরিমাণও সরে যাননি। কোনো ধরনের দয়া প্রার্থনা করেননি; নির্বাসনও চাননি। বরং সব পরিস্থিতিতে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা কম জেনেও তিনি দলকে নির্বাচনমুখী করেন এবং ‘ব্যাকডোর’ সমঝোতার বদলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই বেছে নেন।

মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে গেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, দেশে গণতান্ত্রিক অনিশ্চয়তার সময়ে তাঁর অবস্থান আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল।

সম্প্রতি এক বিবৃতিতে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তাঁকে ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অনন্য অনুপ্রেরণা’ বলে উল্লেখ করেন।

তিনি আরও বলেন, একটি ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর নির্যাতন, মিথ্যা মামলা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির মধ্যেও তাঁর মনোবল ও আপসহীন অবস্থান অনুকরণীয়।

ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল আবেগপূর্ণ। একজন সাবেক ছাত্রনেতা সশস্ত্র বাহিনী দিবসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আপনার আপসহীন অবস্থান সবসময় আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।’

কয়েক প্রজন্ম ধরে বহু মানুষের কাছে খালেদা জিয়া ছিলেন রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রতীক।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনও সংগ্রামের বিষয়, এই বিশ্বাসকে তিনিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন।

তিনি বুঝিয়েছিলেন, বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র শুধু সরকার ব্যবস্থা নয়। বরং এর জন্য মানুষ কারাগার, নির্বাসন, সামাজিক বয়কট, এমনকি ব্যক্তিগত ত্যাগ করতেও প্রস্তুত থাকে।

তাঁর নিজের ভাষায়, ‘ধৈর্য, শালীনতা, সৌজন্য ও ভদ্রতা ছাড়া সংসদীয় রাজনীতি সম্ভব নয়।’

আরেকবার তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘যদি বাংলাদেশ এক পরিবারের শাসনে চলে যায়, তবে তা পুরো অঞ্চলের জন্য বড় ধরনের পিছিয়ে যাওয়া হবে।’

তাঁর মূলমন্ত্র ‘বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হলে আমি সমৃদ্ধ’ এবং ‘এই দেশই আমার একমাত্র ঘর।’

খালেদা জিয়াকে ‘অপসহীন’ বলা মানে তাকে অযথা প্রশংসা করা নয়। সত্যকে স্বীকার করা। 

সমঝোতার রাজনীতির ভিড়ে তিনি প্রতিবাদ, বর্জন, কারাবাস, গৃহবন্দিত্ব ও অপমানের মত কঠিন পথ বেছে নিয়েছিলেন; তবু আপস করেননি।

তাঁর রাজনৈতিক যাত্রায় উত্থান-পতন দুর্বল গণতন্ত্রে নেতৃত্বদান কতটা কঠিন ও জটিল তা নির্দেশ করে।

সংবিধান সংস্কার, শিক্ষাবিস্তারের উদ্যোগ, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, সবই তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে আরও দৃঢ় করেছে।

এ কারণেই বহু বাংলাদেশির কাছে খালেদা জিয়া শুধু একজন নেত্রীই নন, গণতন্ত্রের প্রভাবশালী রক্ষকও।

তিনিই যে বাংলাদেশে জনগণের শাসনের ধারণাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তা বিরোধী মতের লোকেরাও অস্বীকার করতে পারবে না।

আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।