রাজনীতি মূলত মতের ভিন্নতা ও স্বার্থের সংঘাতকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। কিন্তু যখন সেই প্রক্রিয়ায় সমঝোতার ভাষা হারিয়ে যায়, তখন রাজনীতি নিজেই রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকিতে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংলাপ, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ও পারস্পরিক আস্থার জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে, এর মূল্য শুধু রাজনৈতিক দল নয়, দিচ্ছে পুরো রাষ্ট্র ও সমাজ।
সংলাপের সংকট, সিদ্ধান্তের একমুখিতা
যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসে আলোচনা ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে। সংসদ, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ফোরাম কিংবা সরকার–বিরোধী সংলাপ, সবখানেই মতবিনিময়ের সুযোগ থাকা জরুরি। কিন্তু সমঝোতার সংস্কৃতি দুর্বল হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়ে পড়ে একমুখী। এতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বৈচিত্র্য ও বাস্তবতার প্রতিফলন কমে যায়, বাড়ে অসন্তোষ ও অবিশ্বাস।
রাজনীতির ভাষা কঠোর হলে সমাজও বিভক্ত হয়
রাজনীতির ভাষা সমাজের ভাষা গড়ে দেয়। সমঝোতার জায়গা না থাকলে রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক, বিভাজনমূলক ও প্রতিপক্ষ-নিধনকেন্দ্রিক। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে সমাজে, নাগরিকদের মধ্যেও বাড়ে অসহিষ্ণুতা, মতভিন্নতার প্রতি অনীহা। ফলাফল হিসেবে সামাজিক ঐক্য দুর্বল হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য অশনিসংকেত।
প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়, ব্যক্তি শক্তিশালী হয়
সমঝোতার রাজনীতি মূলত প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে। বিপরীতে, সমঝোতা না থাকলে রাজনীতি ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। তখন রাজনৈতিক দল, সংসদ বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়—সবকিছু নির্ভর করে কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির সিদ্ধান্তের ওপর। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে এবং গণতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব
রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সংঘাত অর্থনীতিকে সরাসরি প্রভাবিত করে। বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায় ভোগে, নীতিনির্ধারণে গতি কমে যায়। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয় রাজনৈতিক টানাপোড়েনে। সমঝোতার রাজনীতি না থাকলে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
নাগরিক আস্থার ক্ষয়
রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রতি নাগরিক আস্থা গড়ে ওঠে অন্তর্ভুক্তিমূলক আচরণ ও ন্যায্যতার অনুভূতি থেকে। যখন রাজনীতিতে সমঝোতার জায়গা সংকুচিত হয়, তখন নাগরিকরা নিজেদের সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। ভোট, মতপ্রকাশ কিংবা রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, সবক্ষেত্রেই আগ্রহ কমে যায়। দীর্ঘমেয়াদে এটি গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে।
সমঝোতার রাজনীতি কি এখনও সম্ভব?
সমঝোতা মানে আপস নয়, বরং রাষ্ট্রের স্বার্থে যৌক্তিক ছাড় ও গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক পরিপক্বতা, সহনশীলতা এবং প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক চিন্তা। সরকার ও বিরোধী দল, উভয় পক্ষেরই দায়িত্ব রয়েছে আলোচনার পথ খোলা রাখার। পাশাপাশি নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে সংলাপের সংস্কৃতি জোরদারে।
উপসংহার
রাজনীতিতে সমঝোতার ভাষা হারিয়ে যাওয়ার মূল্য তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান নাও হতে পারে, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি গভীর ও বহুমাত্রিক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক ঐক্য ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই সংকটে। রাষ্ট্র যদি টেকসই পথে এগোতে চায়, তবে সংঘাত নয়, সমঝোতাকেই রাজনীতির কেন্দ্রীয় ভাষা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।