রাজনীতি

রাষ্ট্রযন্ত্র বনাম রাজনৈতিক দল:ধীরে ধীরে ঝাপসা হচ্ছে সীমারেখা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাষ্ট্র চলে নিয়মে, আর রাজনৈতিক দল চলে ক্ষমতার অঙ্কে, এই দুইয়ের মাঝের সীমারেখাটাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গা। তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র নিরপেক্ষ, আর রাজনৈতিক দল পক্ষপাতদুষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে সেই বিভাজন কি আর আগের মতো স্পষ্ট আছে? নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র আর দলের ভেদরেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে- এ প্রশ্নটাই এখন রাজনীতির কেন্দ্রে।


রাষ্ট্রযন্ত্র কার, দলের না জনগণের?

রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে আমরা বুঝি প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনসহ পুরো সরকারি কাঠামোকে- যার কাজ দল নয়, রাষ্ট্রকে চালানো। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায়ই দেখা যায়, ক্ষমতায় থাকা দল রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজের রাজনৈতিক সুবিধার অংশ হিসেবে দেখতে শুরু করে। তখন রাষ্ট্র আর দল যেন আলাদা সত্তা থাকে না, একে অপরের ভেতরে মিশে যায়।

একজন সরকারি কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন, নাকি দলীয় আনুগত্য দেখাচ্ছেন, সেই প্রশ্নের উত্তর অনেক সময় স্পষ্ট হয় না। এখানেই শুরু হয় বিভ্রান্তি, আর এই বিভ্রান্তিই ধীরে ধীরে আস্থার সংকট তৈরি করে।

প্রশাসনের নিরপেক্ষতা: কাগজে-কলমে না বাস্তবে?

নিরপেক্ষ প্রশাসন ছাড়া গণতন্ত্র টিকে থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, বদলি-পোস্টিং, পদোন্নতি, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য একটি অঘোষিত মানদণ্ড হয়ে উঠছে। এতে করে প্রশাসনের ভেতরেই বিভাজন তৈরি হয়—কে ‘বিশ্বাসযোগ্য’, কে নয়।

ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র আর জনগণের কাছে নিরপেক্ষ থাকে না, বরং ক্ষমতাসীন রাজনীতির ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়ে। এতে লাভ হয় দলীয় রাজনীতির, কিন্তু ক্ষতি হয় রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার।


আইনশৃঙ্খলা: নিরাপত্তা নাকি রাজনৈতিক অস্ত্র?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজনৈতিক সংঘাতের সময়ে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, এই বাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারছে না। কে আন্দোলন করছে, কে ক্ষমতায়, এই পরিচয়টাই যেন অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারের ধরন ঠিক করে দেয়।

এখানে প্রশ্নটা বাহিনীর ব্যক্তিগত সদিচ্ছা নয়, বরং কাঠামোগত চাপের। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন দলীয় রাজনীতির চাপের নিচে পড়ে, তখন পেশাদারিত্বও প্রশ্নের মুখে পড়ে।

নির্বাচন ও রাষ্ট্রযন্ত্র: আস্থার জায়গা কোথায়?

নির্বাচন গণতন্ত্রের মূল পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নির্বাচন এলেই রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা—এটা নিজেই একটি রাজনৈতিক সংকেত। কারণ আস্থা একবার নড়বড়ে হয়ে গেলে, নির্বাচন শুধু একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়, উৎসবে রূপ নেয় না।

ভোটার যখন মনে করে, রাষ্ট্রযন্ত্র কারও পক্ষে আগেই দাঁড়িয়ে আছে, তখন ভোটাধিকারও অনেক সময় অর্থহীন মনে হয়।


সীমারেখা ঝাপসা হলে ক্ষতি কার?

অনেকেই ভাবেন, রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয় হলে ক্ষমতাসীন দল লাভবান হয়। স্বল্পমেয়াদে হয়তো কিছু সুবিধা আসে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয় রাষ্ট্রেরই। কারণ—

  • প্রশাসনের পেশাদারিত্ব ক্ষয় হয়

  • প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়

  • বিরোধী রাজনীতি আরও চরমপন্থী হয়ে ওঠে

  • নাগরিক আস্থা ভেঙে পড়ে

সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্র আর নাগরিকের মাঝের বিশ্বাসের সেতু ভেঙে যায়।

বের হওয়ার পথ কি আছে?

এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি, রাতারাতি সমাধানও হবে না। তবে কিছু মৌলিক জায়গায় ফিরে তাকানো জরুরি-

রাষ্ট্রযন্ত্রকে আবারও দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে ভাবতে শেখানো, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতায় থাকাকালীন সংযমের সংস্কৃতি তৈরি করা, আর নাগরিকদের প্রশ্ন করার অধিকারকে ভয় না পাওয়াই পারে এই সীমারেখাকে আবার স্পষ্ট করতে।

শেষ কথা

রাষ্ট্র আর রাজনৈতিক দল, এই দুইয়ের সম্পর্ক সহযোগিতার, অধীনতার নয়। সীমারেখা যত ঝাপসা হবে, গণতন্ত্র ততটাই দুর্বল হবে। আজ যে প্রশ্নটি উঠছে- রাষ্ট্রযন্ত্র বনাম রাজনৈতিক দল, তা আসলে ক্ষমতার নয়, ভবিষ্যতের প্রশ্ন।

কারণ শক্ত রাষ্ট্রযন্ত্র ছাড়া শক্ত রাজনীতি হয় না, আর নিরপেক্ষ রাষ্ট্রযন্ত্র ছাড়া গণতন্ত্র কেবল একটি শব্দ হয়েই থেকে যায়।