দেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় তৃণমূলকে বলা হয় গণতন্ত্রের ভিত্তি। ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, উপজেলা—এই স্তর থেকেই উঠে আসে স্থানীয় নেতৃত্ব, যাদের হাত ধরে সাধারণ মানুষের সমস্যা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা যতই কেন্দ্রের দিকে সরে যাচ্ছে, ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে তৃণমূল রাজনীতি ও স্থানীয় নেতৃত্ব।
আজ প্রশ্ন উঠছে, এই দুর্বলতার কারণ কী? নাকি এটি কেবল সময়ের ফল নয়, বরং একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক বাস্তবতা?
কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বাস্তব চিত্র
বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ক্রমেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। দলীয় নীতিনির্ধারণ, প্রার্থী মনোনয়ন, এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও এখন ওপর থেকেই নির্ধারিত হয়।
এর ফলে স্থানীয় নেতারা আর স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নন; বরং তারা পরিণত হয়েছেন নির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে। স্থানীয় বাস্তবতা, জনদাবি কিংবা এলাকাভিত্তিক সমস্যার গুরুত্ব অনেক সময়ই কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের কাছে হার মানে।
মনোনয়ন রাজনীতি ও নেতৃত্ব সংকট
তৃণমূল রাজনীতির দুর্বলতার অন্যতম বড় কারণ হলো মনোনয়ন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীকরণ। জনপ্রিয়তা, মাঠপর্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা বা দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কাজের চেয়ে দলীয় আনুগত্য ও কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ফলে স্থানীয় পর্যায়ে যাঁরা সত্যিকার অর্থে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন, তাঁরা প্রান্তিক হয়ে পড়েন। আর নেতৃত্বে উঠে আসেন এমন ব্যক্তিরা, যাঁদের সঙ্গে জনগণের সংযোগ তুলনামূলকভাবে দুর্বল।
স্থানীয় সরকার কাঠামোর সীমাবদ্ধতা
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো তাত্ত্বিকভাবে শক্তিশালী হলেও বাস্তবে তাদের ক্ষমতা সীমিত। অর্থনৈতিক বরাদ্দ, প্রকল্প অনুমোদন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত—সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা তীব্র।
এই নির্ভরশীলতা স্থানীয় নেতাদের আত্মবিশ্বাস ও কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। তারা জনগণের কাছে জবাবদিহির চেয়ে ওপরমুখী জবাবদিহিকে বেশি গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন।
রাজনীতিতে ‘ম্যানেজমেন্ট কালচার’
তৃণমূল রাজনীতিতে আদর্শিক রাজনীতির জায়গা দখল করেছে ব্যবস্থাপনাভিত্তিক রাজনীতি। স্থানীয় নেতৃত্ব এখন আর আন্দোলন, জনসংযোগ বা নীতি নিয়ে কাজ করার সুযোগ কম পাচ্ছে; বরং কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই তাদের প্রধান ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর ফলে রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্ব বিকাশের পরিবেশ।
সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা
স্থানীয় নেতৃত্ব দুর্বল হওয়ার সরাসরি প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। মানুষ মনে করছে—স্থানীয় নেতা থাক বা না থাক, সিদ্ধান্ত তো ওপর থেকেই আসে। এই ধারণা রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহ বাড়াচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ভোটারদের সঙ্গে স্থানীয় নেতৃত্বের দূরত্ব বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত।
কীভাবে শক্তিশালী হতে পারে তৃণমূল রাজনীতি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৃণমূল রাজনীতি শক্তিশালী করতে হলে কয়েকটি বিষয় জরুরি-
দলীয় কাঠামোর ভেতরে বিকেন্দ্রীকরণ
স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি
মনোনয়নে তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে শক্তিশালী করা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, স্থানীয় নেতৃত্বকে কেবল রাজনৈতিক কর্মী নয়, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া।
উপসংহার
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়তো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত রাখে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি তৃণমূল রাজনীতিকে দুর্বল করে দেয়। আর তৃণমূল দুর্বল হলে গণতন্ত্রও দুর্বল হয়।প্রশ্ন তাই এখন স্পষ্ট—রাজনীতি কি কেবল কেন্দ্রনির্ভর থাকবে, নাকি আবারও ফিরে যাবে মানুষের কাছে, স্থানীয় নেতৃত্বের হাত ধরে? এর উত্তরই নির্ধারণ করবে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।