এক সময় একটি ভিডিওই ছিল অকাট্য প্রমাণ। ক্যামেরার সামনে যা ধরা পড়েছে, সেটিই সত্য- এমন বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল আধুনিক সাংবাদিকতা ও জনমত। কিন্তু প্রযুক্তির দ্রুত বিবর্তনে সেই বিশ্বাস আজ গভীর সংকটে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় তৈরি হওয়া ডিপফেক ভিডিও ও ছবি সত্য-মিথ্যার সীমারেখা মুছে দিতে শুরু করেছে, যা ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্র, সব ক্ষেত্রেই নতুন ধরনের আতঙ্ক তৈরি করছে।
ডিপফেক কী এবং কেন এত ভয়ংকর
ডিপফেক মূলত এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে কারও মুখ, কণ্ঠ বা অঙ্গভঙ্গি অন্য কারও শরীরে বসিয়ে দেওয়া হয়, এমনভাবে, যা খালি চোখে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। কয়েক বছর আগেও বিষয়টি ছিল গবেষণাগারের সীমাবদ্ধ পরীক্ষা। আজ এটি হাতের মুঠোয় থাকা অ্যাপেই সম্ভব।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, ডিপফেক আর কেবল বিনোদন বা ব্যঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক অপপ্রচার, সামাজিক বিভ্রান্তি, আর্থিক প্রতারণা এবং ব্যক্তিগত সম্মানহানির অস্ত্র হিসেবে।
রাজনীতি ও জনমত নিয়ন্ত্রণে ডিপফেক
বিশ্ব রাজনীতিতে ডিপফেক ইতোমধ্যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। কোনো রাষ্ট্রনেতার ভুয়া ভাষণ, বিরোধী নেতার বানানো স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও বা সেনাবাহিনীর ভুয়া ঘোষণার মতো কনটেন্ট মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক মাধ্যমে। ফলাফল, জনমনে বিভ্রান্তি, উত্তেজনা এবং কখনো কখনো সহিংস পরিস্থিতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সময়ে ডিপফেক হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ‘নীরব অস্ত্র’। কারণ একটি বিশ্বাসযোগ্য ভিডিও মানুষ যাচাই না করেই সত্য ধরে নেয়। পরে সেটি ভুয়া প্রমাণিত হলেও ক্ষতি হয়ে যায় অপূরণীয়।
সাধারণ মানুষের জীবনে নীরব সন্ত্রাস
ডিপফেকের শিকার শুধু রাজনীতিবিদ বা সেলিব্রেটিরা নন। সাধারণ মানুষও এখন ঝুঁকির মুখে। ভুয়া আপত্তিকর ভিডিও বা ছবি বানিয়ে ব্ল্যাকমেইল, সামাজিক লজ্জা এবং মানসিক নিপীড়নের ঘটনা বাড়ছে। বিশেষ করে নারী ও কিশোরীদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব ভয়াবহ।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একটি ভুয়া ভিডিওই কারও চাকরি, পরিবার ও সামাজিক অবস্থান ধ্বংস করে দিতে পারছে। আইনি প্রক্রিয়ায় সেটি মিথ্যা প্রমাণ হলেও সামাজিক ক্ষত সেরে ওঠে না সহজে।
সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা
ডিপফেক সাংবাদিকতার জন্য তৈরি করেছে এক ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ। আগে যেখানে ভিডিও বা অডিও ছিল শক্তিশালী সূত্র, এখন সেখানে সন্দেহ ঢুকে পড়েছে। সংবাদমাধ্যমকে এখন প্রতিটি ভিডিও, ছবি ও কণ্ঠ যাচাই করতে হচ্ছে বহুস্তরে।
ফ্যাক্ট-চেকিং টিম, রিভার্স ইমেজ সার্চ, মেটাডেটা বিশ্লেষণ, সব মিলিয়েও শতভাগ নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। দ্রুত নিউজ ব্রেক করার চাপ আর যাচাইয়ের প্রয়োজন, এই দ্বন্দ্ব সাংবাদিকতার নৈতিকতাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে।
প্রযুক্তিই কি দেবে সমাধান?
আশার কথা, ডিপফেক শনাক্তে প্রযুক্তিও এগোচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি কোম্পানি এমন অ্যালগরিদম তৈরি করছে, যা মুখভঙ্গি, চোখের নড়াচড়া, কণ্ঠের অস্বাভাবিকতা বিশ্লেষণ করে ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত করতে পারে। তবে এখানেও সমস্যা আছে- ডিপফেক তৈরির প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, শনাক্তকরণ প্রযুক্তিকেও তত দ্রুত আপডেট হতে হচ্ছে।
এ যেন এক নিরবচ্ছিন্ন প্রযুক্তিগত দৌড়, যেখানে থামার সুযোগ নেই।
আইন ও নীতির শূন্যতা
ডিপফেক মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো আইনি কাঠামোর ঘাটতি। অনেক দেশেই এ বিষয়ে স্পষ্ট আইন নেই। কোথাও মানহানি আইনে, কোথাও সাইবার অপরাধ আইনে বিষয়টি সামলানো হচ্ছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট। ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার আইনের আওতায় কিছু প্রতিকার সম্ভব হলেও ডিপফেকের মতো জটিল প্রযুক্তিকে সামাল দেওয়ার জন্য আলাদা, সময়োপযোগী নীতিমালা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভবিষ্যৎ কোথায়?
ডিপফেক আমাদের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে- আমরা কি এখন আর চোখে দেখা সত্যকে বিশ্বাস করতে পারি? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার, ভবিষ্যতে সত্য যাচাই হবে আরও জটিল, আরও সময়সাপেক্ষ।
এই নতুন বাস্তবতায় সবচেয়ে প্রয়োজন ডিজিটাল সচেতনতা। সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, আইনপ্রণেতা, সবাইকে একসঙ্গে শিখতে হবে সন্দেহ করতে, যাচাই করতে এবং দায়িত্বশীল হতে। কারণ ডিপফেকের যুগে সবচেয়ে বড় অস্ত্র প্রযুক্তি নয়, সচেতন বোধবুদ্ধি।