তথ্যপ্রযুক্তি

ডিজিটাল যুগে সন্তান প্রতিপালন: ইউনিসেফের ১০ কৌশল

সন্তানদের সঙ্গে প্রযুক্তির একটি সুস্থ, ইতিবাচক ও নিরাপদ সম্পর্ক গড়ে তুলতে কার্যকর পরামর্শ দিয়েছে ইউনিসেফ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডিজিটাল যুগে সন্তান বড় করা মোটেই সহজ নয়। প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া প্রযুক্তি, নতুন অ্যাপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অনলাইন ঝুঁকির ভিড়ে বাবা–মায়েদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কীভাবে ঝুঁকি ও সম্ভাবনার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রাখা যায়।

এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই ডিজিটাল প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ ড. জ্যাকলিন নেসির সঙ্গে কথা বলেছে ইউনিসেফ। তার দেওয়া ১০ টি পদক্ষেপ:

পরিবারে প্রযুক্তির ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করুন-

১. শুরু থেকেই কথা বলুন, নিয়মিত বলুন

সন্তানের হাতে থাকা ডিভাইসকে আলাদা কোনো ‘নিষিদ্ধ জগৎ’ বানাবেন না। স্কুল, খেলাধুলা বা বন্ধুদের মতোই তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়েও আগ্রহ দেখান। কোন অ্যাপ তাদের ভালো লাগে, কোনটা লাগে না, কতক্ষণ ব্যবহার করে, এসব প্রশ্ন করুন স্বাভাবিকভাবেই। এতে শিশুর অনলাইন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।

২. প্রযুক্তির ঝুঁকি নিয়ে সৎ আলোচনা করুন

প্রযুক্তি ব্যবহারে আপনার উদ্বেগ, যেমন অতিরিক্ত স্ক্রিনটাইম, অনুপযুক্ত কনটেন্ট বা অনলাইনে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, এসব বিষয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন। ভয় দেখিয়ে নয়, যুক্তি ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে।

একই সঙ্গে সন্তানকে স্পষ্টভাবে জানান- অনলাইনে কোনো সমস্যায় পড়লে যেন সে নির্ভয়ে আপনার কাছে আসে। আপনি চাইলে এভাবে বলতে পারেন,

“অনলাইনে সব পরিস্থিতি সামলানো সহজ নয়। কখনো এমন কিছু দেখা বা অভিজ্ঞতা হতে পারে যা তোমাকে বিভ্রান্ত বা কষ্ট দিতে পারে। তখন আমি চাই তুমি আমার কাছে আসো, আমরা একসঙ্গে সমাধান খুঁজব।”

এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- সন্তান যখন সত্যিই আপনার কাছে আসে, তখন আপনার প্রতিক্রিয়া। রাগ, দোষারোপ বা সঙ্গে সঙ্গে ডিভাইস কেড়ে নেওয়ার বদলে বলুন,

“আমাকে বলার জন্য ধন্যবাদ।”

এতে ভবিষ্যতেও সে আপনার ওপর ভরসা করতে শিখবে।

৩. সমস্যার মূল কারণ খুঁজে দেখুন

সব সমস্যার জন্য প্রযুক্তিকে দায়ী করা ঠিক নয়। অনেক সময় শিশুর মানসিক চাপ, আত্মবিশ্বাসের অভাব বা সামাজিক উদ্বেগই ডিভাইস ব্যবহারের আচরণে প্রকাশ পায়। যেমন—কোনো কিশোর যদি বারবার সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করতে থাকে, তবে সেটির পেছনে হয়তো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক বা স্কুলজীবনের কোনো অস্বস্তি কাজ করছে।

পরিবারের জন্য বাস্তবসম্মত সীমারেখা ঠিক করুন

৪. ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’—দুই ধরনের নিয়ম তৈরি করুন

‘হ্যাঁ’ নিয়ম মানে-

অনলাইনে কেমন আচরণ প্রত্যাশিত, ভালো ডিজিটাল নাগরিক হওয়া বলতে কী বোঝায়।

‘না’ নিয়ম মানে-

যা করা যাবে না, যেমন অন্যকে অনলাইনে হেনস্তা করা বা ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা।

সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন। ভুল হবেই, শেখার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। যদি তারা সৎভাবে কোনো সমস্যার কথা জানায়, তবে শাস্তির ভয় দেখাবেন না।

৫. প্রযুক্তিমুক্ত সময় ও জায়গা নির্ধারণ করুন

পরিবার হিসেবে কিছু সময় বা জায়গাকে প্রযুক্তিমুক্ত রাখুন—যেমন খাবারের টেবিল বা ঘুমানোর আগে। চাইলে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ডিভাইস রাখার নিয়ম করতে পারেন। রাতে ঘুমের সময় ডিভাইস বেডরুমের বাইরে রাখা খুবই কার্যকর অভ্যাস। ভালো ঘুম শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।

৬. কনটেন্ট নিয়ে স্পষ্ট প্রত্যাশা রাখুন

সন্তান যে কনটেন্ট দেখছে তা বয়স ও মানসিক বিকাশের সঙ্গে মানানসই কি না—সেদিকে নজর দিন। নতুন অ্যাপ ডাউনলোড বা নতুন প্ল্যাটফর্মে যোগ দেওয়ার আগে আপনার অনুমতি নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রয়োজনে স্ক্রিনটাইম, কনটেন্ট ফিল্টার বা প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার করুন।

সন্তানের অনলাইন জগতে সচেতন উপস্থিতি রাখুন

৭. একসঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবহার করুন

সব বয়সের সন্তানের ক্ষেত্রেই ‘কো-ভিউয়িং’ বা একসঙ্গে দেখা ও ব্যবহার উপকারী। একসঙ্গে কোনো অনুষ্ঠান দেখা, গেম খেলা বা তাদের প্রিয় অ্যাপ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। এতে সন্তান নিজেকে বুঝতে পারা ও সম্মানিত মনে করে।

৮. কখন পিছিয়ে আসতে হবে, তা বুঝুন

ছোট শিশু বা নতুন ডিভাইস ব্যবহার শুরু করা সন্তানের ক্ষেত্রে কিছুটা নজরদারি জরুরি—তবে আগেই জানিয়ে দিন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব ও স্বাধীনতাও ধীরে ধীরে দিন। তবু সামগ্রিকভাবে তারা অনলাইনে কী করছে, সে সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন।

নিজেই হয়ে উঠুন রোল মডেল

৯. পরিবার হিসেবে এক টিম হয়ে কাজ করুন

বাবা–মায়ের নিজের ডিভাইস ব্যবহারের অভ্যাসও সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে। ‘আমি বনাম তুমি’ নয়, বরং ‘আমরা একসঙ্গে’—এই মানসিকতা নিয়ে প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করুন।

১০. প্রযুক্তিকে আনন্দের মাধ্যম বানান

প্রযুক্তি মানেই শুধু ঝুঁকি নয়। একসঙ্গে গেম খেলা, নতুন কিছু শেখা, রান্না বা সংগীতের ভিডিও দেখা—এসবের মাধ্যমে প্রযুক্তি পরিবারে আনন্দ ও সৃজনশীলতার সুযোগ তৈরি করতে পারে।

বিশেষজ্ঞ পরিচিতি

ড. জ্যাকলিন নেসি যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির মনোরোগ ও মানব আচরণ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন।

তিনি ‘টেকনো স্যাপিয়েন্স ’ নামের সাপ্তাহিক নিউজলেটারের লেখক এবং ডিজিটাল যুগে সন্তান প্রতিপালন বিষয়ক কোর্স Tech Without Stress– এর সহ-প্রণেতা।

তথ্যসূত্র- ইউনিসেফ