তথ্যপ্রযুক্তি

অ্যালগরিদমের শাসন:সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে নীরব নিয়ন্ত্রক

নিজস্ব প্রতিবেদক

একসময় মানুষ সংবাদপত্র খুলে খবর পড়ত, টেলিভিশনের সামনে বসে আলোচনা শুনত। কোন খবরটি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি নয়, সে সিদ্ধান্ত আসত সম্পাদকীয় নীতির ভেতর দিয়ে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এসে সেই সিদ্ধান্তের ভার ধীরে ধীরে চলে গেছে অদৃশ্য এক শক্তির হাতে- অ্যালগরিদম।

আজ ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার), টিকটক বা ইনস্টাগ্রামে আমরা যা দেখি, যেভাবে দেখি, এমনকি কতক্ষণ দেখি, সবই নির্ধারিত হচ্ছে কিছু কোড, ডেটা ও গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে। প্রশ্ন হলো, এই অ্যালগরিদম কি কেবল ব্যবহারকারীর পছন্দ বুঝে কনটেন্ট দেখাচ্ছে, নাকি ধীরে ধীরে আমাদের চিন্তা, মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দিচ্ছে?

অ্যালগরিদম কী, আর কেন এটি ক্ষমতাশালী:

সহজ ভাষায়, অ্যালগরিদম হলো এমন একটি স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়া, যা ব্যবহারকারীর আচরণ বিশ্লেষণ করে ঠিক করে—কোন কনটেন্ট আগে দেখানো হবে, কোনটা আড়ালে থাকবে। আপনি কোন পোস্টে লাইক দিলেন, কতক্ষণ একটি ভিডিও দেখলেন, কোন লেখার নিচে থামলেন, এই সব তথ্য জমে তৈরি হয় আপনার একটি ডিজিটাল প্রোফাইল।

এই প্রোফাইলের ভিত্তিতেই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম সিদ্ধান্ত নেয়, আপনি ‘কি দেখতে চান’। কিন্তু এখানেই সমস্যা। আপনি যা দেখতে চান, আর আপনি যা জানলে সমাজ সচেতন হতো, এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অ্যালগরিদম সচেতনতা নয়, অগ্রাধিকার দেয় এনগেজমেন্টকে; কারণ যত বেশি সময় আপনি স্ক্রিনে থাকবেন, তত বেশি বিজ্ঞাপন, তত বেশি মুনাফা।


মতাদর্শ গঠনের নীরব কারিগর

অ্যালগরিদমের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক মতাদর্শে। ব্যবহারকারী এক ধরনের মত বা দৃষ্টিভঙ্গির কনটেন্টে আগ্রহ দেখালে, অ্যালগরিদম তাকে ধীরে ধীরে একই ঘরানার আরও কনটেন্ট দেখাতে থাকে। ফলে তৈরি হয় ‘ইকো চেম্বার’, যেখানে ভিন্নমত অনুপস্থিত, প্রশ্ন করার সুযোগ কমে যায়।

এর ফল হিসেবে মানুষ ভাবতে শুরু করে, ‘সবাই আমার মতোই ভাবছে’। বাস্তবে সমাজ বহুমাত্রিক হলেও, ডিজিটাল জগতে মতাদর্শ সংকুচিত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক মেরুকরণ বাড়ে, সহনশীলতা কমে, যুক্তির জায়গায় আবেগ প্রাধান্য পায়।

খবর নয়, ভাইরালই মুখ্য

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও অ্যালগরিদম বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। আগে খবরের গুরুত্ব নির্ধারণ করতেন সম্পাদক; এখন সেটি নির্ভর করছে কতটা ‘ভাইরাল’ হওয়ার সম্ভাবনা আছে তার ওপর। গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনেক সময় অ্যালগরিদমের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে, আর বিভ্রান্তিকর বা উত্তেজক কনটেন্ট সামনে চলে আসে।

ফলে সংবাদমাধ্যমও চাপের মুখে পড়ে, বিশ্লেষণের বদলে ক্লিকযোগ্য শিরোনাম, তথ্যের বদলে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে জনমতকে দুর্বল করে, গণতান্ত্রিক চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ডিপফেক, ভুয়া খবর ও অ্যালগরিদমিক সুবিধা

ভুয়া খবর বা ডিপফেক ভিডিও ছড়াতে অ্যালগরিদম কার্যত অনুঘটকের ভূমিকা রাখে। যে কনটেন্টে আবেগ, ভয় বা ক্ষোভ বেশি, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অ্যালগরিদম সেটাকেই ‘জনপ্রিয়’ ধরে নিয়ে আরও বেশি মানুষের সামনে তুলে ধরে।

এভাবে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য ঝাপসা হয়ে যায়।

ব্যবহারকারী বুঝতেই পারেন না।তিনি তথ্য দেখছেন, নাকি পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা একটি বর্ণনা গ্রহণ করছেন।

ব্যবহারকারী কি একেবারেই অসহায়?

পুরোপুরি নয়। অ্যালগরিদম শক্তিশালী হলেও, এটি মানুষের আচরণের ওপরই নির্ভরশীল। সচেতন ব্যবহার, ভিন্নমত পড়ার অভ্যাস, যাচাই না করে শেয়ার না করা, এসবই অ্যালগরিদমিক প্রভাব কমাতে পারে।

একই সঙ্গে প্রয়োজন নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা। অ্যালগরিদমের স্বচ্ছতা, ডেটা ব্যবহারে জবাবদিহি, এবং প্ল্যাটফর্মগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

উপসংহার

অ্যালগরিদম নিজে কোনো রাজনৈতিক দল নয়, কোনো মতাদর্শও নয়। কিন্তু যেভাবে এটি তথ্য বাছাই করে, অগ্রাধিকার দেয় এবং উপস্থাপন করে। তাতে এটি হয়ে উঠেছে এক নীরব ক্ষমতাকেন্দ্র। প্রশ্ন এখন আর ‘সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করব কি না’, তা নয়। প্রশ্ন হলো, আমরা কি বুঝে ব্যবহার করছি, নাকি অজান্তেই আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাস ছেড়ে দিচ্ছি কিছু লাইনের কোডের হাতে?

প্রযুক্তি আমাদের হাতিয়ার হবে, না আমাদের শাসক!

এই সিদ্ধান্ত এখনো মানুষের হাতেই আছে।