এক সময় প্রযুক্তি দুনিয়ায় সবচেয়ে উচ্চারিত শব্দ ছিল, ‘ মেটাভার্স’। ফেসবুক থেকে মেটা হওয়া, ভার্চুয়াল অফিস, ডিজিটাল অবতার, থ্রি-ডি ইন্টারনেট, সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ যেন চোখের সামনে। কিন্তু সেই উন্মাদনা বেশিদিন টেকেনি। বিনিয়োগ কমেছে, বড় বড় প্রকল্প বন্ধ হয়েছে, কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর এসেছে। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন- মেটাভার্স বুঝি নিছকই একটি অতিরঞ্জিত প্রযুক্তি বুদবুদ।
কিন্তু নীরবতার এই সময়টাই যে প্রস্তুতির সময় ছিল, তা এখন স্পষ্ট হচ্ছে। ২০২৫ সালের শুরুতে নতুন করে বিনিয়োগ, গবেষণা ও কৌশলগত পরিবর্তনের মাধ্যমে মেটাভার্স আবার আলোচনায় ফিরছে, তবে আগের মতো হৈচৈ নয়, বরং বাস্তবতা আর ব্যবসায়িক যুক্তির ভিত্তিতে।
উন্মাদনা থেকে বাস্তবতায় ফেরা
প্রথম দফায় মেটাভার্স নিয়ে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, তার বড় অংশই ছিল কল্পনানির্ভর। সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার তখনও ব্যয়বহুল, ইন্টারনেট অবকাঠামো অনেক দেশে প্রস্তুত নয়, আর ব্যবহারযোগ্য কনটেন্টও সীমিত ছিল। ফলে বড় বিনিয়োগের বিপরীতে প্রত্যাশিত রিটার্ন আসেনি।
এই বাস্তবতায় অনেক প্রতিষ্ঠান পেছনে সরে গেলেও পুরো ধারণা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। বরং তারা সময় নিয়েছে, প্রযুক্তি পরিণত হওয়ার, ব্যবহারকারীর অভ্যাস বদলানোর এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, মেটাভার্সকে ‘শো-পিস’ থেকে ‘সল্যুশন’ বানানোর জন্য।
নতুন বিনিয়োগ, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
বর্তমান বিনিয়োগের ধারা আগের চেয়ে অনেক বেশি টার্গেটেড। এখন আর শুধু ভার্চুয়াল কনসার্ট বা ডিজিটাল জমি নয়- মেটাভার্স ব্যবহার হচ্ছে বাস্তব সমস্যার সমাধানে।
কর্পোরেট ট্রেনিং ও রিমোট ওয়ার্ক:
বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ভার্চুয়াল সিমুলেশনের মাধ্যমে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যেখানে বাস্তব পরিবেশে ভুলের ঝুঁকি নেই।
স্বাস্থ্য ও মানসিক চিকিৎসা:
ভার্চুয়াল থেরাপি, ফোবিয়া ট্রিটমেন্ট ও রিহ্যাবিলিটেশনে মেটাভার্স কার্যকর মাধ্যম হয়ে উঠছে।
শিক্ষা খাত:
মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভোকেশনাল শিক্ষায় থ্রি-ডি লার্নিং বাস্তব অভিজ্ঞতার কাছাকাছি সুযোগ তৈরি করছে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন ও ম্যানুফ্যাকচারিং: ডিজিটাল টুইন প্রযুক্তির মাধ্যমে কারখানা বা যন্ত্রের ভার্চুয়াল সংস্করণে আগেই ত্রুটি শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।
এই খাতগুলোতে বিনিয়োগকারীরা এখন ঝুঁকি দেখছেন কম, সম্ভাবনা দেখছেন বেশি।
এআই ও মেটাভার্স: নতুন জোট
মেটাভার্সের দ্বিতীয় জীবনের পেছনে সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)। আগে যেখানে ভার্চুয়াল জগৎ ছিল স্থির ও স্ক্রিপ্টেড, এখন সেখানে এআই যুক্ত হয়ে তৈরি করছে ইন্টার্যাকটিভ চরিত্র, স্মার্ট পরিবেশ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা।
এআই-এর মাধ্যমে-
ভার্চুয়াল অবতার আরও মানবিক আচরণ করছে
কনটেন্ট তৈরির খরচ ও সময় কমছে
ব্যবহারকারীর আচরণ অনুযায়ী পরিবেশ নিজেই বদলে যাচ্ছে
ফলে মেটাভার্স আর শুধু একটি ভার্চুয়াল স্পেস নয়, বরং একটি অভিযোজিত ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে রূপ নিচ্ছে।
বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কৌশল বদল
আগে যেখানে ‘সব একসাথে’ মেটাভার্স বানানোর চেষ্টা ছিল, এখন সেখানে ধাপে ধাপে এগোনোর কৌশল। হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও কনটেন্ট, সবকিছু এক ছাতার নিচে না এনে, আলাদা আলাদা সেগমেন্টে উন্নয়ন করা হচ্ছে।
এতে একদিকে ব্যয় কমছে, অন্যদিকে ব্যবহারকারীর জন্য প্রযুক্তিটি হয়ে উঠছে তুলনামূলক সহজ ও ব্যবহারযোগ্য। বিশেষ করে লাইটওয়েট হেডসেট, মোবাইলভিত্তিক ভিআর ও ওয়েব-ভিত্তিক মেটাভার্স প্ল্যাটফর্ম এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য কী বার্তা?
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মেটাভার্স এখনো বিলাসী প্রযুক্তি মনে হলেও, শিক্ষা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও রিমোট সার্ভিস খাতে এটি বড় সুযোগ তৈরি করতে পারে। ভার্চুয়াল ট্রেনিং সেন্টার, ডিজিটাল ক্লাসরুম কিংবা আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সিংয়ে ইমারসিভ অভিজ্ঞতা, এসব ক্ষেত্র ভবিষ্যতে নতুন দরজা খুলতে পারে।
ভবিষ্যৎ: নীরব কিন্তু গভীর
মেটাভার্সের বর্তমান পুনরুত্থান আগের মতো ঝলমলে নয়। নেই বড় বড় প্রতিশ্রুতি, নেই রাতারাতি বিপ্লবের গল্প। তবে আছে ধীর, স্থির এবং বাস্তবমুখী অগ্রযাত্রা।
প্রযুক্তির ইতিহাস বলে- যেসব ধারণা প্রথমে ব্যর্থ মনে হয়, পরিণত সময়ে সেগুলোই সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করে। মেটাভার্সও হয়তো সেই পথেই হাঁটছে- নীরবে, কিন্তু গভীরভাবে।