রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক একসময় সীমাবদ্ধ ছিল কাগজপত্র, ফাইলের স্তূপ আর দীর্ঘ লাইনের ভেতর। সরকারি অফিস মানেই ধীরগতি, জটিলতা আর অনিশ্চয়তার প্রতীক। কিন্তু ডিজিটাল যুগে সেই চিত্র বদলানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে সামনে এসেছে ই-গভর্ন্যান্স।
একটি ধারণা, যা নাগরিক সেবা সহজ, দ্রুত ও স্বচ্ছ করার দাবি করে।
প্রশ্ন হলো, ই-গভর্ন্যান্স কি সত্যিই প্রশাসনকে নাগরিকবান্ধব করছে, নাকি এটি কেবল পুরোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ওপর বসানো এক নতুন ডিজিটাল আবরণ?
ই-গভর্ন্যান্স কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
ই-গভর্ন্যান্স বলতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে সরকারি সেবা প্রদান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনাকে বোঝায়। জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, কর প্রদান, সামাজিক সুরক্ষা ভাতা কিংবা অনলাইন অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, এসবই ই-গভর্ন্যান্সের আওতায় পড়ে।
এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য তিনটি-
সময় সাশ্রয়, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি কমানো।
নাগরিক যেন ঘুষ বা তদবির ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেবা পান, সেটিই ই-গভর্ন্যান্সের দর্শন।
ডিজিটাল সেবায় গতি ও স্বচ্ছতার অগ্রগতি
ই-গভর্ন্যান্সের সবচেয়ে দৃশ্যমান অর্জন হলো সেবার গতি। অনলাইন আবেদন ও ট্র্যাকিং ব্যবস্থার ফলে অনেক সেবায় অপেক্ষার সময় কমেছে। ফাইল কোথায় আটকে আছে, আবেদন কোন পর্যায়ে- এই তথ্য এখন নাগরিক নিজেই দেখতে পারেন।
এতে একদিকে যেমন অফিসে বারবার যাওয়ার প্রয়োজন কমেছে, অন্যদিকে তদবির ও অনানুষ্ঠানিক লেনদেনের সুযোগও সীমিত হয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত ও তথ্য অনলাইনে প্রকাশ পাওয়ায় প্রশাসনিক কার্যক্রম আগের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে।
ডিজিটাল প্রশাসনের অদৃশ্য জটিলতা
তবে বাস্তবতা এতটা সরল নয়। ই-গভর্ন্যান্স অনেক ক্ষেত্রে নাগরিকের জন্য নতুন ধরনের জটিলতা তৈরি করেছে। ইন্টারনেট সংযোগ, স্মার্ট ডিভাইস ও ডিজিটাল দক্ষতা, এই তিনটি না থাকলে অনলাইন সেবা অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য।
ফলে যে নাগরিক সেবা সহজ করার কথা ছিল, সেটিই হয়ে উঠছে আরেকটি বাধা। বিশেষ করে প্রবীণ, দরিদ্র ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য ডিজিটাল ফর্ম, পাসওয়ার্ড, ওটিপি বা সার্ভার সমস্যার মোকাবিলা সহজ নয়।
মানবিক সেবার জায়গা কি সংকুচিত হচ্ছে?
ই-গভর্ন্যান্সের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- মানবিক যোগাযোগের জায়গা। ডিজিটাল ব্যবস্থায় নাগরিক আর কর্মকর্তা মুখোমুখি হন না। এতে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত প্রভাব কমে, অন্যদিকে অনেক সময় সমস্যার ব্যাখ্যা বা ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি তুলে ধরার সুযোগও হারিয়ে যায়।
সিস্টেম যদি ভুল করে, নাগরিক তখন কার কাছে যাবেন? এই উত্তর অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট নয়। ফলে ‘ডিজিটাল ভুল’ কখনো কখনো আরও জটিল হয়ে ওঠে।
স্বচ্ছতা বনাম তথ্য নিয়ন্ত্রণ
ই-গভর্ন্যান্স স্বচ্ছতা বাড়ালেও, এটি রাষ্ট্রের হাতে বিপুল নাগরিক তথ্য কেন্দ্রীভূত করছে। কার তথ্য কোথায় সংরক্ষিত, কে তা ব্যবহার করছে, কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে, এই প্রশ্নগুলো ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ডেটা সুরক্ষা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত না হলে ই-গভর্ন্যান্স নাগরিকের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে ঝুঁকির কারণ হতে পারে। প্রযুক্তি যখন সিদ্ধান্ত নেয়, তখন জবাবদিহি কার- এই প্রশ্নেরও স্পষ্ট নীতিগত উত্তর প্রয়োজন।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে ই-গভর্ন্যান্সের বাস্তবতা
বাংলাদেশে ই-গভর্ন্যান্স বিস্তারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। একদিকে প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা, অন্যদিকে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব, এই দুই মিলিয়ে অনেক ডিজিটাল সেবা প্রত্যাশিত মানে পৌঁছাতে পারছে না।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনলাইন সেবার পাশাপাশি অফলাইন প্রক্রিয়াও চালু থাকে, ফলে নাগরিককে দ্বিগুণ ভোগান্তি পোহাতে হয়। এটি ই-গভর্ন্যান্সের মূল দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
পথ কোন দিকে?
ই-গভর্ন্যান্স সফল করতে হলে প্রযুক্তির পাশাপাশি মানুষকেও গুরুত্ব দিতে হবে। নাগরিকদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মকর্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, এবং সেবার মানবিক বিকল্প পথ খোলা রাখা জরুরি।
একই সঙ্গে প্রয়োজন শক্তিশালী ডেটা সুরক্ষা আইন ও স্বচ্ছ নীতিমালা, যাতে প্রযুক্তি নাগরিকের ওপর কর্তৃত্ব নয়, বরং সেবার হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
উপসংহার
ই-গভর্ন্যান্স নিজে কোনো চূড়ান্ত সমাধান নয়; এটি একটি প্রক্রিয়া। সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে এটি প্রশাসনকে স্বচ্ছ ও নাগরিকবান্ধব করতে পারে। কিন্তু যদি প্রযুক্তিকে উদ্দেশ্য বানানো হয়, মানুষের প্রয়োজনকে নয়, তাহলে এই ডিজিটাল ব্যবস্থা নতুন জটিলতার জন্ম দেবে।
প্রশ্ন তাই প্রযুক্তি থাকবে কি থাকবে না, তা নয়। প্রশ্ন হলো, ই-গভর্ন্যান্স নাগরিকের ক্ষমতা বাড়াবে, নাকি নাগরিককে আরেক ধাপ দূরে সরিয়ে দেবে? এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে ডিজিটাল প্রশাসনের