মূল্যস্ফীতি কমার দাবি, বাজারে স্বস্তি নেই: ভোক্তা কেন এখনো চাপে

মূল্যস্ফীতি কমার দাবি, বাজারে স্বস্তি নেই: ভোক্তা কেন এখনো চাপে
প্রকাশিত

পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতি কমছে—এমন খবর এখন নিয়মিতই শোনা যাচ্ছে। সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। কিন্তু বাজারে পা রাখলেই এই দাবির সঙ্গে বাস্তবতার অদ্ভুত এক বৈপরীত্য চোখে পড়ে। চাল, ডাল, তেল, সবজি—কোনোটাই আগের দামে ফিরছে না। প্রশ্ন উঠছে, যদি মূল্যস্ফীতি কমেই থাকে, তবে ভোক্তা কেন এখনো স্বস্তি পাচ্ছে না?

সংখ্যার ভাষা বনাম বাজারের ভাষা

মূল্যস্ফীতি মূলত একটি গড় হিসাব। কিছু পণ্যের দাম কমলে, কিছু পণ্যের দাম বেশি বাড়লেও সামগ্রিক হার কম দেখাতে পারে। কিন্তু ভোক্তার জীবন চলে নির্দিষ্ট কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর। সেই পণ্যের দাম যদি না কমে, তাহলে পরিসংখ্যান যতই আশাবাদী হোক, বাস্তবে তার প্রতিফলন পড়ে না।

নিত্যপণ্যে ‘দাম আটকে থাকার’ প্রবণতা

বাজারে একটি বিষয় স্পষ্ট—দাম বাড়ে দ্রুত, কিন্তু কমে ধীরে। কাঁচামাল, পরিবহন বা ডলারের অজুহাতে একবার দাম বাড়লে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সেই দাম আর আগের জায়গায় ফেরে না। ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এটিকে ‘সমন্বয়’ বলে ব্যাখ্যা করলেও ভোক্তার কাছে এটি স্পষ্টতই চাপের কারণ।

ডলার সংকট ও আমদানি ব্যয়ের দীর্ঘ ছায়া

ডলারের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হলেও আমদানি ব্যয়ের প্রভাব বাজার থেকে এখনো পুরোপুরি কাটেনি। অনেক ব্যবসায়ী আগের উচ্চ দামে আমদানি করা পণ্য বিক্রি করছেন। ফলে নতুন করে দাম কমানোর সুযোগ থাকলেও তা বাস্তবে ঘটছে না। এই ‘ল্যাগ ইফেক্ট’ মূল্যস্ফীতি কমার সুফল ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে দেরি করাচ্ছে।


ভোগব্যয়ে চাপ, কিন্তু চাহিদা কমছে না

আয় বাড়েনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। তবু নিত্যপণ্যের চাহিদা কমানোর সুযোগ নেই। ফলে মানুষ বাধ্য হয়েই বেশি দামে কিনছে। এতে একদিকে যেমন পরিবারিক বাজেট ভেঙে পড়ছে, অন্যদিকে সঞ্চয় কমে যাচ্ছে। এই চাপ দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।

মধ্যস্বত্বভোগীর দাপট

চাষি বা উৎপাদক পর্যায়ে দাম কমলেও ভোক্তা পর্যায়ে তার প্রতিফলন পড়ে না—এর পেছনে বড় কারণ মধ্যস্বত্বভোগীর চক্র। সরবরাহ ব্যবস্থায় যত বেশি হাত বদল, দাম তত বাড়ে। নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি দুর্বল হলে এই চক্র আরও শক্তিশালী হয়, যার খেসারত দেয় সাধারণ মানুষ।

সুদের হার ও উৎপাদন ব্যয়ের প্রভাব

উচ্চ সুদের হার উৎপাদন ব্যয় বাড়াচ্ছে। উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, উৎপাদন বাড়ছে না। উৎপাদন কম হলে সরবরাহে চাপ তৈরি হয়, যা দাম কমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মূল্যস্ফীতি কমার গতি বাজারে ধরা পড়ে না।

আস্থার সংকট ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বাজারে দামের ক্ষেত্রে একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় কাজ করে। মানুষ যখন মনে করে দাম আবার বাড়বে, তখন আগেভাগেই কিনে রাখে। এই আচরণ কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে, যা দাম কমার সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দেয়। ফলে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাজারে আস্থার ঘাটতি থেকে যায়।

নীতির সুফল ভোক্তার কাছে পৌঁছাচ্ছে কি

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিগত উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার সুফল শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে সময় লাগছে। কর–শুল্ক সমন্বয়, সরবরাহ ব্যবস্থার সংস্কার, বাজার তদারকি—এই জায়গাগুলোতে দুর্বলতা থাকলে কাগজে-কলমের সাফল্য বাস্তবে ফল দেয় না।

ভোক্তার স্বস্তি ফিরবে কীভাবে

ভোক্তার স্বস্তি ফিরতে হলে শুধু মূল্যস্ফীতির হার কমা যথেষ্ট নয়। দরকার নিত্যপণ্যের বাজারে বাস্তব দামের পতন, মধ্যস্বত্বভোগী নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন ব্যয় কমানোর উদ্যোগ এবং আয় বৃদ্ধির সুযোগ। না হলে মূল্যস্ফীতি কমার খবর কেবল শিরোনামেই থাকবে, বাজারে নয়।

শেষ কথা

মূল্যস্ফীতি কমার দাবি আর বাজার বাস্তবতার এই ফাঁকই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই ফাঁক না কমলে ভোক্তার আস্থা ফিরবে না, আর আস্থা ছাড়া অর্থনীতির গতি টেকসই হয় না। সংখ্যার বাইরে গিয়ে বাস্তব বাজারে স্বস্তি আনাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com