ইন্টারনেট বন্ধ মানেই অদৃশ্য অর্থনৈতিক ক্ষতি

ইন্টারনেট বন্ধ মানেই অদৃশ্য অর্থনৈতিক ক্ষতি
প্রকাশিত

একটি বোতাম চাপলেই ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই এক ক্লিকের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে হাজারো লেনদেন, চাকরি, ব্যবসা ও আস্থার ওপর। বাংলাদেশে ইন্টারনেট এখন আর বিলাসিতা নয় এটি অর্থনীতির মৌলিক অবকাঠামো। তবু বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা কিংবা রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইন্টারনেট বন্ধ বা ধীর করে দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো- এই সিদ্ধান্তের প্রকৃত অর্থনৈতিক মূল্য আমরা কতটা বুঝি?

ডিজিটাল অর্থনীতির নীরব শিরা-

আজকের বাংলাদেশে ইন্টারনেটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যবসা, রাইড শেয়ারিং, ফ্রিল্যান্সিং, ই–কমার্স, রপ্তানিমুখী আইটি সেবা এমনকি প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশ।

একটি ছোট অনলাইন দোকান থেকে শুরু করে বড় সফটওয়্যার কোম্পানি, সবাই প্রতিদিন নিরবচ্ছিন্ন সংযোগের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়া মানে শুধু ফেসবুক বা ইউটিউব বন্ধ হওয়া নয়; এটি মানে অর্থনৈতিক প্রবাহে হঠাৎ ব্রেক কষা।

একদিন নেট বন্ধ থাকলে কী হয়? বাস্তব ক্ষতির চিত্র-

ইন্টারনেট বন্ধ হলে প্রথম আঘাত আসে লেনদেনে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে বিল পরিশোধ থেমে যায়, ই–কমার্স ডেলিভারি আটকে পড়ে, রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ হয়ে যায়।

ফ্রিল্যান্সাররা কাজ জমা দিতে পারেন না, বিদেশি ক্লায়েন্টের আস্থা নড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে একটি দিন নেট না থাকলেই মাসব্যাপী কাজ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়।

ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষেত্রে এই ক্ষতি আরও ভয়াবহ, কারণ তাদের বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

ফ্রিল্যান্সিং ও রপ্তানি সেবায় আঘাত-

বাংলাদেশের অনলাইন শ্রমশক্তি এখন বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কাজের সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ক্লায়েন্ট শুধু অপেক্ষা করে না, সে বিকল্প খুঁজে নেয়।

একবার বিশ্বাস নষ্ট হলে তা ফিরিয়ে আনা কঠিন। ফলে নেট শাটডাউন শুধু তাৎক্ষণিক আয় নয়, ভবিষ্যৎ আয়ের পথও সংকুচিত করে।

ব্যবসায়িক আস্থা ও বিনিয়োগের প্রশ্ন-

ডিজিটাল অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো আস্থা। দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন শুধু কর বা অবকাঠামো নয়, সংযোগের স্থায়িত্বও বিবেচনায় নেন।

যে দেশে ইন্টারনেট অনিশ্চিত, সেখানে ডেটা–ভিত্তিক ব্যবসা, কল সেন্টার, সফটওয়্যার হাব কিংবা আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে সতর্ক হয়ে ওঠে। এই ক্ষতি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে গভীর।

শিক্ষা ও মানবসম্পদে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব-

অনলাইন শিক্ষা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, রিমোট ট্রেনিং, সবই ইন্টারনেটনির্ভর। নেট বন্ধ হলে শুধু আজকের ক্লাস বন্ধ হয় না; ভবিষ্যৎ দক্ষ জনশক্তি তৈরির ধারাও বাধাগ্রস্ত হয়।

বিশেষ করে গ্রাম ও প্রান্তিক অঞ্চলে, যেখানে বিকল্প শেখার সুযোগ সীমিত, সেখানে এই ক্ষতি আরও বেশি।

নিরাপত্তা বনাম অর্থনীতি: ভারসাম্যের সংকট-

নিরাপত্তা একটি রাষ্ট্রের বৈধ উদ্বেগ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- সম্পূর্ণ বা ব্যাপক ইন্টারনেট বন্ধই কি একমাত্র সমাধান?

বিশ্বের অনেক দেশ এখন লক্ষ্যভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ, কনটেন্ট–নির্দিষ্ট পদক্ষেপ বা প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের দিকে যাচ্ছে, যাতে পুরো অর্থনীতি অচল না হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও এই আলোচনা ক্রমেই জরুরি হয়ে উঠছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশে নেট বন্ধের বাস্তবতা-

ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণা কেবল প্রযুক্তি ব্যবহারের গল্প নয়; এটি স্থায়িত্ব ও নির্ভরযোগ্যতার প্রতিশ্রুতি।

যদি সংযোগই অনিশ্চিত থাকে, তাহলে ডিজিটাল রূপান্তর কাগজে–কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।

ইন্টারনেট শাটডাউন: সংখ্যায় ক্ষতির ছবি

সাম্প্রতিক সময়ের বড় আকারের ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের ঘটনায় বাংলাদেশে ডিজিটাল অর্থনীতিতে মোট ক্ষতি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি বলে বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে।

  • শুধু ই–কমার্স ও অনলাইন ব্যবসা খাতে প্রতিদিন গড়ে ১০০–১২০ কোটি টাকার লেনদেন ব্যাহত হয়েছে, যার বড় অংশ আর ফিরে আসেনি।

  • কয়েক দিনের শাটডাউনের মধ্যেই আইসিটি ও অনলাইন সার্ভিস সেক্টরে ক্ষতি ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, যেখানে ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, সফটওয়্যার সার্ভিস ও কনটেন্ট ব্যবসা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

  • এর আগের বছরগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট সীমিত থাকায় বাংলাদেশ সম্মিলিতভাবে প্রায় ৭০ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি বৈদেশিক আয় হারিয়েছে, যা রপ্তানিমুখী ডিজিটাল সেবার জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হয়।

  • ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং খাতে অনেক ক্ষেত্রে এক দিনের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা মানেই পুরো মাসের কাজ হারানোর ঝুঁকি, কারণ বিদেশি ক্লায়েন্টরা বিকল্প দেশ বা কর্মী খুঁজে নেয়।

  • দীর্ঘমেয়াদে এই অনিশ্চয়তার প্রভাব শুধু তাৎক্ষণিক আয় নয়; নতুন বিনিয়োগ, স্টার্টআপ পরিকল্পনা ও বৈদেশিক আস্থার ওপরও নেতিবাচক চাপ তৈরি করে।

উপসংহার-

ইন্টারনেট বন্ধ একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হতে পারে, কিন্তু এর প্রভাব অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বৈশ্বিক। প্রতিটি শাটডাউন বাংলাদেশের ডিজিটাল বিশ্বাসযোগ্যতায় একটি অদৃশ্য দাগ ফেলে।

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে হলে ইন্টারনেটকে শুধু যোগাযোগ মাধ্যম নয়, অর্থনৈতিক অবকাঠামো হিসেবে দেখতে হবে। কারণ আধুনিক অর্থনীতিতে নেট বন্ধ মানেই, দেশের একটি অংশকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দেওয়া।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com