কারখানা বন্ধ, উৎপাদন কমছে: কর্মসংস্থানে নীরব সংকট

কারখানা বন্ধ, উৎপাদন কমছে: কর্মসংস্থানে নীরব সংকট
প্রকাশিত

এক সময় যে শিল্পকারখানাগুলো ছিল কর্মসংস্থানের প্রধান ভরসা, আজ সেখানেই নেমে এসেছে অদৃশ্য এক অচলাবস্থা। হঠাৎ করে কোনো বড় ঘোষণা নেই, নেই শ্রমিক আন্দোলনের জোরালো শিরোনাম, তবু নীরবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা, কমছে উৎপাদন, আর সেই সঙ্গে ঝরে পড়ছে হাজারো কর্মসংস্থান। এই সংকট চোখে পড়ছে না বলে যে গভীর নয়, তা কিন্তু নয়।

বন্ধের খাতায় নাম লেখা হচ্ছে চুপিসারে

সরকারিভাবে খুব কম কারখানাই ‘বন্ধ’ ঘোষণা দেয়। বাস্তবে দেখা যায়, কেউ উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়েছে, কেউ শিফট কমিয়েছে, কেউ আবার লে-অফ না দেখিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করছে ধাপে ধাপে। পোশাক, প্লাস্টিক, হালকা প্রকৌশল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ- প্রায় সব খাতেই এই চিত্র কমবেশি একই। বাইরে থেকে কারখানা চালু মনে হলেও ভেতরে কর্মচাঞ্চল্য নেই, অর্ডার নেই, নতুন নিয়োগ তো দূরের কথা।

উৎপাদন কমার পেছনের অদৃশ্য চাপ

উৎপাদন কমার মূল কারণ হিসেবে উদ্যোক্তারা বারবার তিনটি বিষয়ের কথা বলছেন—কাঁচামালের দাম, জ্বালানি ব্যয় আর অর্থের সংকট। আমদানি নির্ভর কাঁচামালের দাম ডলার সংকটে বেড়েছে, বিদ্যুৎ–গ্যাসের অনিশ্চয়তা উৎপাদন পরিকল্পনা এলোমেলো করে দিচ্ছে, আর ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ নতুন বিনিয়োগকে প্রায় অসম্ভব করে তুলছে। অনেক উদ্যোক্তা বলছেন, লাভ তো দূরের কথা—এখন টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জ।

শ্রমবাজারে নীরব ঝরে পড়া

এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার শ্রমিক। বড় ধরনের ছাঁটাইয়ের খবর না এলেও বাস্তবে কাজ হারাচ্ছেন অনেকে। কেউ সপ্তাহে কম দিন কাজ পাচ্ছেন, কারও ওভারটাইম বন্ধ, কারও আবার বেতন আটকে যাচ্ছে মাসের পর মাস। নতুন চাকরির সুযোগও তৈরি হচ্ছে না। ফলে একদিকে যেমন বেকারত্ব বাড়ছে, অন্যদিকে কর্মরতদের আয়ও কমে যাচ্ছে—যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে ভোগব্যয়ে।

ভোক্তা বাজারে চাপের ঢেউ

কর্মসংস্থান কমার প্রভাব শুধু শ্রমিকেই সীমাবদ্ধ নয়। যখন মানুষের হাতে টাকা কমে, তখন বাজারে কেনাকাটা কমে যায়। এই কম চাহিদা আবার ব্যবসার ওপর চাপ তৈরি করে, উৎপাদন আরও কমে—এক ধরনের দুষ্টচক্র তৈরি হয়। শহরের বড় শপিং মল থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার দোকান—সবখানেই বিক্রি কমার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সবচেয়ে ঝুঁকিতে

বড় শিল্পগোষ্ঠী কোনোভাবে টিকে থাকার কৌশল বের করতে পারলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) পড়েছে সবচেয়ে বড় সংকটে। তাদের পুঁজি কম, ব্যাংক ঋণ পাওয়া কঠিন, আর বাজারে দরকষাকষির ক্ষমতাও সীমিত। ফলে অনেক এসএমই কারখানা সাময়িকভাবে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে, কেউ কেউ পুরোপুরি গুটিয়ে নিচ্ছে ব্যবসা। এর প্রভাব কর্মসংস্থানে আরও গভীর ক্ষত তৈরি করছে।

 
পরিসংখ্যানের আড়ালের বাস্তবতা

কাগজে-কলমে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি খুব নাটকীয়ভাবে বদলেছে—এমন তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ কমছে, দৈনিক মজুরিভিত্তিক কাজ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। এই বাস্তবতা পরিসংখ্যানে ধরা না পড়লেও মানুষের জীবনে তার প্রভাব স্পষ্ট।

নীতি সহায়তা না এলে সংকট বাড়বে

উদ্যোক্তারা বলছেন, এই মুহূর্তে প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক নীতি সহায়তা। কম সুদের ঋণ, জ্বালানি সরবরাহে স্থিতিশীলতা, কর ও ভ্যাট কাঠামোয় বাস্তবসম্মত ছাড়—এসব না এলে উৎপাদন বাড়ানো কঠিন। শুধু বড় শিল্প নয়, এসএমই খাতকে বাঁচাতে আলাদা মনোযোগ জরুরি, নইলে কর্মসংস্থানের সংকট আরও গভীর হবে।

নীরব হলেও ভয়ংকর সংকেত

কারখানা বন্ধ হওয়া আর উৎপাদন কমার এই প্রবণতা এখনই বড় শিরোনাম না হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভয়ংকর হতে পারে। কর্মসংস্থান কমে গেলে শুধু অর্থনীতি নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতাও চাপে পড়ে। তাই এই নীরব সংকেতকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সময় থাকতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে, এই নীরব সংকট একদিন উচ্চস্বরে আঘাত হানবেই।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com