কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অর্থনৈতিক ফল: ক্ষেতে ক্ষতি, বাজারে অস্থিরতা

কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অর্থনৈতিক ফল: ক্ষেতে ক্ষতি, বাজারে অস্থিরতা
প্রকাশিত

দেশের অর্থনীতির ভিত্তি কৃষি, এ কথা বলা হয় প্রায়ই। কিন্তু সেই কৃষিই যখন ন্যায্যমূল্য পায় না, তখন ক্ষতি শুধু কৃষকের ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকে না; তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাজার ব্যবস্থায়, ভোক্তা ব্যয়ে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে। মাঠে উৎপাদন ঠিক থাকলেও কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এখন এক ধরনের কাঠামোগত সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

ফসল ঘরে, লাভ বাইরে

প্রায় প্রতি মৌসুমেই একই দৃশ্য- ধান, আলু, পেঁয়াজ বা সবজি উৎপাদনে ভালো ফলন, কিন্তু বাজারে দাম পড়ে যায় উৎপাদন খরচের নিচে। কৃষক বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করেন, কারণ সংরক্ষণ সুবিধা নেই, হাতে নগদ দরকার, ঋণের চাপ আছে। কয়েক সপ্তাহ পর সেই পণ্যই শহরের বাজারে কয়েকগুণ দামে বিক্রি হয়। লাভের বড় অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে।

কৃষকের আয় কমলে অর্থনীতি থামে

কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেলে তার হাতে নগদ থাকে না। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভোগব্যয় কমে যায়। কাপড়, নির্মাণসামগ্রী, গৃহস্থালি পণ্য সবকিছুর চাহিদা কমতে থাকে। এই প্রভাব শহরের বাজারেও পড়ে। অর্থাৎ কৃষকের লোকসান মানেই শুধু একটি শ্রেণির ক্ষতি নয়, পুরো অর্থনৈতিক চক্রে গতি কমে যাওয়া।

উৎপাদনে অনীহা ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি

বারবার লোকসানের মুখে পড়লে কৃষক পরের মৌসুমে উৎপাদনে আগ্রহ হারান। কেউ ফসলের জমি কমান, কেউ বিকল্প পেশায় ঝুঁকেন। এর ফল দেখা দেয় কিছুদিন পর, হঠাৎ করে বাজারে পণ্যের ঘাটতি তৈরি হয়, দাম বেড়ে যায়। তখন ভোক্তা চাপে পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে। আজ কৃষকের লোকসান, কাল ভোক্তার দুর্ভোগ, এই দুষ্টচক্র বারবার ঘুরছে।

মধ্যস্বত্বভোগী নির্ভর বাজারব্যবস্থা

কৃষিপণ্যের বাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সরাসরি বাজারে পৌঁছানোর সুযোগের অভাব। কৃষক উৎপাদন করেন, কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন অন্যরা। আড়তদার, পাইকার, পরিবহনকারী। প্রতিটি ধাপে দাম বাড়ে, কিন্তু কৃষক পান সবচেয়ে কম। এই কাঠামো ভাঙা না গেলে ন্যায্যমূল্যের প্রশ্নে অগ্রগতি কঠিন।

সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ঘাটতি

সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় কৃষক মৌসুমে পণ্য ধরে রাখতে পারেন না। ফলে একসঙ্গে বেশি সরবরাহ হলে দাম পড়ে যায়। আবার অফ-সিজনে সেই পণ্য আমদানি করতে হয় বা বেশি দামে কিনতে হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প দুর্বল থাকায় কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজনও হচ্ছে না, যা কৃষকের আয়ের সুযোগ সীমিত করে দিচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা

ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সরকারিভাবে সংগ্রহ কর্মসূচি থাকলেও তা সব কৃষকের কাছে পৌঁছায় না। অনেক সময় দাম ঘোষণার সঙ্গে বাস্তব বাজারের ব্যবধান থাকে, আবার কোথাও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় প্রকৃত কৃষক সুবিধা পান না। ফলে নীতির উদ্দেশ্য ভালো হলেও মাঠপর্যায়ে তার সুফল সীমিত হয়ে যায়।

<div class="paragraphs"><p>কৃষক দাম না পেলেও, সিন্ডিকেটের চাপে বাজার থাকছে গরম</p></div>

কৃষক দাম না পেলেও, সিন্ডিকেটের চাপে বাজার থাকছে গরম

ভোক্তা কেন উপকৃত হচ্ছে না

কৃষক কম দামে বিক্রি করলেও ভোক্তা সেই সুবিধা পান না। কারণ সরবরাহ চেইনে স্বচ্ছতা নেই। এতে একদিকে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত, অন্যদিকে ভোক্তা বেশি দামে কিনতে বাধ্য। দু’পক্ষই চাপের মধ্যে থাকে, লাভবান হয় মাঝখানের একটি গোষ্ঠী।

সমাধানের পথ কোথায়

কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে সরাসরি কৃষক, বাজার সংযোগ বাড়াতে হবে, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সক্ষমতা জোরদার করতে হবে, এবং মধ্যস্বত্বভোগী নির্ভরতা কমাতে হবে। একই সঙ্গে বাজার তদারকি ও তথ্যভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ জরুরি, যাতে কৃষক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কী উৎপাদন করবেন।

শেষ কথা

কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া শুধু কৃষকের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়; এটি একটি অর্থনৈতিক সতর্ক সংকেত। কৃষক বাঁচলে বাজার বাঁচে, বাজার স্থিতিশীল থাকলে অর্থনীতি শক্ত হয়। তাই ন্যায্যমূল্যের প্রশ্নটি শুধু সহানুভূতির নয়, এটি টেকসই অর্থনীতির জন্য একটি মৌলিক শর্ত। এই বাস্তবতা যত দ্রুত বোঝা যাবে, দেশের অর্থনীতি তত দ্রুত ভারসাম্য ফিরে পাবে।

আরো পড়ুন

No stories found.
logo
The Metro TV | দ্য মেট্রো টিভি | The Metro TV Bangladesh | Bangla News Today | themetrotv.com |The Metro TV News
themetrotv.com