

বাংলাদেশের রপ্তানি খাত দীর্ঘদিন ধরেই একটি সাফল্যের গল্প হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে আসছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় অংশ আসে রপ্তানি থেকে, যার প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প। কিন্তু এই সাফল্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে একটি গভীর ঝুঁকি, রপ্তানি আয়ের অতিমাত্রায় এক খাতনির্ভরতা। বৈশ্বিক বাজারে সামান্য ধাক্কাও যে পুরো অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
এক খাতে ভর করে রপ্তানি চাকা
দেশের মোট রপ্তানি আয়ের বড় অংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে এবং শিল্পায়নের গতি দিয়েছে। তবে সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন অন্য সম্ভাবনাময় খাতগুলো কাঙ্ক্ষিতভাবে এগোতে পারে না। চামড়া, হিমায়িত খাদ্য, কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল, ওষুধ কিংবা আইটি সেবার মতো খাতগুলো রপ্তানি আয়ের তালিকায় থাকলেও তাদের অবদান এখনো সীমিত।
বৈশ্বিক ঝুঁকিতে নাজুক অবস্থান
রপ্তানি যখন একটি খাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তখন বৈশ্বিক বাজারের যেকোনো পরিবর্তন সরাসরি আঘাত হানে। ক্রেতা দেশগুলোর মন্দা, নীতিগত পরিবর্তন, শ্রম বা পরিবেশ সংক্রান্ত নতুন শর্ত, সবকিছুর প্রভাব পড়ে একই জায়গায়। পোশাক খাতে অর্ডার কমলে তার প্রভাব শুধু শিল্পেই নয়; ব্যাংকিং খাত, কর্মসংস্থান, এমনকি রেমিট্যান্স ও ভোগব্যয়েও প্রতিফলিত হয়।
বৈচিত্র্য না এলে আয়ের স্থিতিশীলতা নেই
রপ্তানি বৈচিত্র্য অর্থনীতির জন্য একটি সুরক্ষা বেষ্টনী। একটি খাতে ধাক্কা এলেও অন্য খাতগুলো তা সামাল দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এই বাফার এখনো দুর্বল। ফলে রপ্তানি আয় ওঠানামা করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিনিময় হার ও আমদানি সক্ষমতার ওপর সরাসরি চাপ পড়ে। অর্থনীতির এই সংবেদনশীলতা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ।
সম্ভাবনা থাকলেও বাধা কেন কাটছে না
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে রপ্তানি বৈচিত্র্যের সম্ভাবনার অভাব নেই। সমস্যা মূলত কাঠামোগত। দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি, গবেষণা ও উন্নয়নে কম বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকা এবং নীতি সহায়তার অসামঞ্জস্য—এসব কারণে নতুন খাতগুলো প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারছে না। পাশাপাশি লজিস্টিকস ব্যয় ও সময়ও অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় বেশি।
বাজার বহুমুখীকরণেও দুর্বলতা
পণ্যের পাশাপাশি বাজারও প্রায় একই রকম সীমাবদ্ধ। রপ্তানির বড় অংশ নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশে কেন্দ্রীভূত। ফলে কোনো একটি বাজারে চাহিদা কমলে বিকল্প পথ দ্রুত তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে। নতুন বাজারে প্রবেশের জন্য প্রয়োজন কূটনৈতিক উদ্যোগ, বাণিজ্য চুক্তি ও মান নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা, যেগুলোতে আরও জোর দেওয়া জরুরি।
এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ধীরে ধীরে কমে আসবে। তখন প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। যদি রপ্তানি খাত তখনও এক খাতে আটকে থাকে, তাহলে আয়ের ওপর চাপ বাড়বে। এই প্রেক্ষাপটে রপ্তানি বৈচিত্র্য শুধু প্রয়োজন নয়, এটি হয়ে উঠেছে সময়ের দাবি।
নীতিগত করণীয় কী
বিশ্লেষকদের মতে, সম্ভাবনাময় খাত চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা দিতে হবে। কর ও প্রণোদনায় স্থিতিশীলতা, প্রযুক্তি হালনাগাদে সহজ অর্থায়ন, দক্ষতা উন্নয়ন এবং গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া রপ্তানি বৈচিত্র্য সম্ভব নয়। একই সঙ্গে উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা প্রয়োজন।
শেষ কথা
রপ্তানিতে সাফল্যের গল্প যতই উজ্জ্বল হোক, বৈচিত্র্যহীনতার ঝুঁকি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। একটি খাতের ওপর ভর করে এগোনো অর্থনীতি দীর্ঘদিন টেকসই হতে পারে না। সময় থাকতে রপ্তানি খাতকে বহুমুখী না করা গেলে, সামান্য বৈশ্বিক ঝাঁকুনিতেই দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের চাপে পড়তে পারে। তাই রপ্তানি বৈচিত্র্য এখন আর কেবল বিকল্প নয়, এটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অপরিহার্য শর্ত।